বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গ্যাসের লিকজনিত দুর্ঘটনা ঠেকাতে বাংলাদেশি তরুণদের প্রযুক্তি উদ্ভাবন

রাজধানীর উত্তরায় রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা লিকজনিত দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজন প্রাণ হারায়। এরপর ধানমন্ডি এলাকায় একটি বাসায় একই রকম দুর্ঘটনায় এক নারীর মৃত্যু হয়। গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার এমন খবরই প্রায় প্রতিদিনিই সংবাদমাধ্যমে আসে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি গ্যাসজনিক দুর্ঘটনা ঘটে। আর বছরে ৫ হাজার ১২৩টির বেশি গ্যাস লাইনের লিকেজ এবং বাসাবাড়ি, খাবার হোটেল, অফিসে চুলার গ্যাসজনিত দুর্ঘটনা ঘটে। এমন দুর্ঘটনা কমাতে ‘স্নিফার’ নামের একটি ডিভাইস তৈরি করেছেন তরুণ রেজাউল কবীর।

ডিভাইসটি ব্যহার করলে সংশ্লিষ্ট স্থানে গ্যাস লিকেজ হলে গন্ধ পেয়ে ডিভাইসটি অ্যালার্ম বাজাবে। দ্রুত লিকেজের উৎস চিহ্নিত করে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই ডিভাইসটি গত ২৫ মে ‘ন্যাশনাল ডেমো ডে’-তে স্টার্টআপ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে।

উদ্ভাবকরা জানাল, কোনও বদ্ধ ঘরে যদি লিকেজ হয়ে ৭০০-৮০০ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন) গ্যাস জমা হয় তাহলে সে অবস্থাকে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্নিফার ডিভাইসটি অতদূরে যেতে দেবে না। ২০০ পিপিএম গ্যাস জমলেই অ্যালার্ম বাজাতে শুরু করবে। ফলে দ্রুত সতর্ক হওয়া যাবে।

ডিভাইসটি উদ্ভাবন করেছে তরুণ উদ্ভাবক রেজা উল কবীর। রেজা জানায়, তিতাস গ্যাসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে এই ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮১৯টি। ২০১৪-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১২৩টিতে। এই হিসাব অনুযায়ী, দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রতি ২ ঘণ্টায় একটি।

রেজা আরও বলেন, শুধু গ্যাসের চুলা থেকে গ্যাস নির্গত হলে নয়, গ্যাস সঞ্চালন লাইন (মূল লাইন থেকে বাসা-বাড়িতে সংযোগের গ্যাসের লাইন) গ্যাস বের হলেই ডিভাইসটি অ্যালার্ম বাজাবে। এছাড়া নেইলপলিশের রিমুভার, তারপিন, অ্যারোসলের ক্যান এবং যে কোনও ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট গ্যাসকেও চিহ্নিত করতে পারে এই ডিভাইস।

ডিভাইসটির উদ্ভাবন করা প্রসঙ্গে রেজাউল কবীর বলে, ‘গ্যাস লিকেজজনিত দুর্ঘটনার বিষয়টিকে মাথায় রেখে দীর্ঘদিন গবেষণা করে আমাদের আমাদের টিম গ্যাস সেন্সরযুক্ত ছোট একটা সার্কিট বানায়। যেটা ছিল একটা ফাংশনাল প্রোটোটাইপ। নাম দেওয়া হয় স্নিফার। এর কাজ ছিল গন্ধ পেয়ে আর বিপদ দেখলেই ‘বিপ’ শব্দ করে ওঠা। টেস্টিং পর্বে ছোট একটা ত্রুটি ধরা পড়ে। আমরা প্রায় এক হাজার মাদার বোর্ড বাতিল করে দেই। আবার নতুন করে ডিজাইন করে দুজন বিশেষজ্ঞের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠাই। তারা নিজ নিজ ল্যাবে আলাদাভাবে বিস্তারিত পরীক্ষার পর সবুজ সংকেত দেয়। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

জানা গেল, স্নিফারের পরবর্তী সংস্করণে আরও উন্নত করা হচ্ছে ডিভাইসটিকে। এখন ডিভাইসটি শুধু সংকেত দিলেও আগামীতে মোবাইল ফোনে এসএমএস দিয়েও জানাতে পারবে তথ্য। আনা হবে এর জন্য বিশেষায়িত অ্যাপ। যে অ্যাপ থেকে ডিভাইসটির পাঠানো গ্যাসজনিত সমস্যার সব ধরনের তথ্যসহ আরও আপডেট তথ্য জানা যাবে। প্রথম স্লটে যতগুলো ডিভাইস তারা বানিয়েছিল প্রি-অর্ডার নিয়ে তার সবগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। পরে আবারও নতুন করে বানানোর কাজ শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে এই ডিভাইসটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ আয়োজিত আইসিটি ইনোভেশন প্রোগ্রাম-২০১৭ এ সেরা উদ্ভাবন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ওই প্রতিযোগিতায় ‘টপ ইনভেস্টেবল স্টার্টআপ’ হিসেবে খ্যাতিও কুড়িয়েছে। রেজা উল কবীর তাদের স্টার্টআপটির নাম দিয়েছে জলপাই ইলেকট্রনিকস। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে জলপাই ইলেকট্রনিকস গ্রামীণফোনের একসেলেটর এবং এসডি-এশিয়ার পার্টনার হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মাইক্রো-ইজের মতো ইউরোপীয় হাইটেক প্রতিষ্ঠান।

জলপাই তাদের পণ্যটির গায়ে লিখছে না ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। তারা লিখছে ‘মেড ইন ঢাকা’। রেজা উল কবীরের যুক্তি হলো, মেড ইন বাংলাদেশ হলো একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি। আর ‘মেড ইন ঢাকা’ হলো একটা গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম। আমরা এটাকে ওই গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।’

রেজা আরও বলে, ‘আমি ঢাকার বাসিন্দা। যেখানেই যাই না কেন ভুল যাই না তা। এ কারণে আমরা বলছি, মেড ইন ঢাকা।’

রেজা উল কবীর বলেছে, ‘শুরু থেকেই আমরা প্রচুর সাড়া পেয়েছি। আগে প্রি-অর্ডার করলেও এখন আমরা আমাদের অনলাইন সাইটের মাধ্যমে বিক্রি করছি।’

Back to top button