ইসলাম

সাদপন্থীরা আখেরী মোনাজাতে যায়নি

Image result for কাকরাইল মসজিদ ঢাকা

মাওলানা সা’দ কান্ধলভীকে কেন্দ্র করে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে চলা বিশ্ব তাবলীগ জামায়াতের দুইপক্ষের বিরোধের স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমায়। নেতৃত্ব নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে বাংলাদেশের তাবলীগ জামায়াতেও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের মধ্যস্ততায় ৫ জন শীর্ষ আলেম এ বিভেদ প্রশমনের দায়িত্ব পেলেও, বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে। ৩৮টি দেশের প্রতিনিধিরা এলেও এবারের ইজতেমায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন বাংলাদেশের তাবলীগের একাংশের নেতারা।

ইজতেমা বর্জনে মাওলানা সা’দপন্থীরা
তাবলীগ জামায়াতের কেন্দ্রস্থল ভারতের দিল্লীর নিজামুদ্দীন মারকাযের জিম্মাদার মাওলানা সা’দ কান্ধলভী ২০১৫ সাল থেকে ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করছেন। নেতৃত্ব ও নিজের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের মধ্যে থাকায় বিক্ষোভের মুখে তাকে এবার ইজতেমায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। তাই তাবলীগ জামায়াতের বৃহত্তম এ জমায়েত বর্জন করেছেন তার অনুসারীরা।

শনিবার রাত পর্যন্ত এ অংশের নেতারা ইজতেমায় যাননি, রোববার ইজতেমার প্রথম পর্বের শেষদিনেও যাবেন না বলে জানিয়েছিলেন তারা।

বাংলাদেশের তাবলীগের কেন্দ্রস্থল কাকরাইলের শীর্ষ নীতি-নির্ধারণী পরিষদ হিসেবে ১১ জন শুরা সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে এ অংশের ৩ জন শুরা সদস্য এবারের ইজতেমায় যাননি।

শুরা সদস্য খান সাহাবুদ্দিন নাসিম শনিবার রাতে জানান, তিনি কাকরাইল মসজিদে অবস্থান করছেন। এতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি মুঠোফোনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

তবে এ অংশের নেতৃত্বদানকারী শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম  বলেন, ‘আমরা ৩ জন শুরা সদস্য ইজতেমায় যাইনি। কারণ তারা আমাদের আমীরকে (মাওলানা সা’দ) সেখানে যেতে দেয়নি।’

মাওলানা সা’দের অনুসারীরা এবারের ইজতেমার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

এ অংশের একজন নেতা নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইজতেমায় যাওয়ার মতো নিরাপত্তা আমরা দেখিনি। অনেক ছাত্রকে লাঠি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মাওলানা সা’দের অনুসারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদেশি মেহমানদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। মাওলানা সা’দকে অংশ নিতে না দেওয়ায় অনেক দেশের লোক চলে গেছে। ইজতেমায় এবার ৬০ ভাগ লোকও আসেনি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গেঞ্জাম (ঝামেলা) চাই না, গেঞ্জাম হতে পারে ভেবে আমরা ইজতেমায় যাইনি।’মাওলানা সাদ

এসব বিষয়ে কথা বলতে ইজতেমায় অংশ নেওয়া মাওলানা সা’দবিরোধী শুরা সদস্যদের কাউকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

দ্বন্ধের শুরু ভারতে
ভারতের নিজামুদ্দীন মারকাযে বিশ্ব তাবলীগের নেতৃত্ব নিয়ে চলমান বিরোধের জের ধরে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের তাবলীগেও বিভেদ দেখা দেয়।

জানা যায়, দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ইলিয়াস কান্ধলভী  ভারতের মেওয়াত অঞ্চলে ১৯২০ সালে তাবলীগের সূচনা করেন। ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই তিনি মারা গেলে তার পুত্র ইউসুফ কান্ধলবিবিশ্ব তাবলীগের আমীর হন। ১৯৬৫ সালে তার মৃত্যুর পর আমির হন মাওলানা এনামুল হাসান।

১৯৯৫ সালে এনামুল হাসান মারা যাওয়ার পর একক আমীর নির্বাচনের প্রথা থেকে সরে এসে শুরা পদ্ধতি (শীর্ষ নেতৃত্বে একাধিকজনের প্যানেল) চালু করে বিশ্ব তাবলীগ জামায়াত। মাওলানা এজাহার, মাওলানা যোবায়েরুল হাসান ও মাওলানা সা’দ কান্ধলভীকে (প্রতিষ্ঠাতার নাতি) শুরা সদস্য করে পরিচালিত হতে থাকে তাবলীগ।

তবে ২০১৪ সালের মার্চে মাওলানা যোবায়েরুল হাসান মারা যাওয়ার পর (মাওলানা এজাহার তার পূর্বেই মারা যান) নেতৃত্ব নিয়ে তাবলীগে দ্বন্ধ দেখা দেয়। তিন সদস্যের ওই শুরা কমিটির একমাত্র জীবিত সদস্য মাওলানা সা’দ একক আমীর হওয়ার চেষ্টা করলে দারুল উলুম দেওবন্দ, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, সাহরানপুর মাজাহিরুল উলুম মাদরাসাসহ ভারত-পাকিস্তানের তাবলীগের প্রবীণরা এর বিরোধীতা করে। পরবর্তীতে ১০ সদস্যের একটি শুরা কমিটির খসড়া করা হলেও মাওলানা সা’দ তা মেনে নেননি। আর শুরা না মেনে সা’দ একক নেতৃত্ব গ্রহণ করায় দেওবন্দ মাদরাসার তাবলীগের প্রবীণরা নিজামুদ্দিন মারকায ত্যাগ করেন, পাশাপাশি মাওলানা সা’দকে বয়কট করে বিবৃতিও দেন।

গত সাড়ে ৩ বছরেও এ নিয়ে ঐক্যে পৌঁছতে পারেনি বিশ্ব তাবলীগ। ফলে বিভিন্ন সময়ে ভারতে তাবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। একইভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দুই বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাবলীগ জামায়াত।

ঐক্য প্রক্রিয়া ব্যর্থ বাংলাদেশেও
মাওলানা সা’দকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের তাবলীগও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কাকরাইলের শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি অংশ সা’দের একক নেতৃত্বের পক্ষে, এই অংশটি কাকরাইলে বেশ প্রভাবশালী। অন্যদিকে আরেক শুরা সদস্য মাওলানা যোবায়ের হোসেনের নেতৃত্বে একটি অংশ সা’দের নেতৃত্বের বিরোধীতা করে দেওবন্দের অবস্থানের পক্ষে, হেফাজতে ইসলামসহ দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোতে এই অংশের প্রভাব বেশি।

২০১৫ ও ‘১৬ সালের ইজতেমায় মাওলানা সা’দ আখেরি মোনাজাত করলেও তা নিয়ে তেমন মতবিরোধ দেখা যায়নি। তবে ২০১৭ সালের ইজতেমাকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ সামনে আসে। ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তাবলীগের প্রবীণরা মাওলানা সা’দ একক নেতৃত্ব ছেড়ে শুরা পদ্ধতি না মানলে তারা টঙ্গীতে আসবেন না জানালে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। পরে ওই বছরের ২৫ অক্টোবর মাওলানা আহমদ শফী কাকরাইল মারকাযকে চিঠি দিয়ে মাওলানা সা’দকে ইজতেমায় না আনতে বলেন। পরে দেশের ৪০ জন শীর্ষ আলেমও একই দাবি জানান। পাশাপাশি মাওলানা সা’দকে অতিথি করা হলে ইজতেমা বর্জনের কথা জানায় দেওবন্দের অনুসারী দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো।

এ নিয়ে বাংলাদেশের তাবলীগের শীর্ষ নীতি-নির্ধারণী পরিষদ কাকরাইলের শুরারাও দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যান। তবে সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম মাওলানা সা’দকে আনার সিদ্ধান্তে স্থির থাকায় তাবলীগের বিরোধ আরও বেড়ে যায়। পরে সা’দকে অতিথি করায় গতবছরের ইজতেমায় ভারতের অনেক প্রবীণ অংশ নেননি।

এসব ঘটনায় এক বছরের বেশি সময় ধরে কাকরাইলসহ বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় তাবলীগের মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ, মামলার ঘটনায় দেখা দেয়। চলতি ইজতেমা নিয়ে যা আরও বেড়ে যায়।

এর মধ্যে গত ১১ নভেম্বর উত্তরায় কয়েকজন শীর্ষ আলেম সভা করে ইজতেমায় সা’দকে না আনার দাবি জানান। ওই সভায় হেফাজতের আমীর আল্লামা শফীর পাঠানো লিখিত বক্তব্যেও একই দাবি জানানো হয়। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপও প্রত্যাশা করেন তারা।

পরে ১৪ নভেম্বর কাকরাইলে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাবলীগের দুই অংশ। পরে ঢাকা জেলার ডিসি, রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত ওসিসহ অন্যদের উপস্থিতিতে বৈঠকে ‘তাবলীগের কার্যক্রমে কেউ অস্ত্র নিয়ে আসতে পারবে না’সহ ৬টি বিষয়ে অঙ্গীকার করেন তাবলীগের শুরারা। পাশাপাশি ৩ ভাগের দুই ভাগ সদস্যের ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অঙ্গীকার করেন তারা। তবে ১৭ নভেম্বরই এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ভারতের অতিথিদের বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে চিঠি দেন ওয়াসিফুল ইসলাম।

এ দ্বন্দ্ব নিরসনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাবলীগের দুই অংশ ও শীর্ষ আলেমদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করে। সে অনুযায়ী তাবলীগের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে গিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যস্ততায় এ মতবিরোধ দূর করতে তাবলীগের উপদেষ্টা হিসেবে শীর্ষ ৫ জন আলেমকে নিয়ে উলামায়ে পরিষদ করা হয়।

এ পরিষদের সদস্যরা হলেন- কওমি মাদরাসা সমূহের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রকারী সংস্থা আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ির মুহতামিম ও গুলশান সেন্ট্রাল (আজাদ) মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমূদুল হাসান, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আল্লামা আবদুল কুদ্দুছ, শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ ও মারকাজুদ দাওয়াহ বাংলাদেশের আমিনুত তালীম মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক। এ পরিষদ সমঝোতা ছাড়া মাওলানা সা’দকে ইজতেমায় আনার বিরোধিতা করেন।

তবে এসব উদ্যোগেও জটিলতা কমেনি তাবলীগের। বরং গত ১০ জানুয়ারী একাংশের আপত্তির মধ্যেই মাওলানা সা’দ ঢাকায় এলে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্ততায় তিনি ফিরে যান। এতে আখেরি মোনাজাত পরিচালনার দায়িত্ব পান মাওলানা যোবায়ের, আর তা বর্জন করেন সৈয়দ ওয়াসিফপন্থীরা।

এই দ্বন্দ্ব নিরসন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে উলামায়ে পরিষদের সদস্য মাওলানা মাহমূদুল হাসানের পক্ষে তার ছেলে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘সবাই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে সমঝোতা সম্ভব না।’

এ কমিটির আরেক সদস্য আল্লামা আশরাফ আলী বলেন, ‘যাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, তাকে (সা’দ) তো ফেরত পাঠানো হয়েছে।’

দুই পক্ষের মতবিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা তারাই বলতে পারবে, কেন সমঝোতায় আসছে না।’বিশ্ব ইজতেমা

এ বিষয়ে কাকরাইলের শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম চ্যানেল আইকে বলেন, ‘ইজতেমা যাক, এরপর ঐক্যের বিষয়টি দেখা যাবে। তখন আবার আমরা একসাথে বসবো।’

শুরার আরেক সদস্য মাওলানা মোশাররফ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

১৯৪৬ সাল থেকেই বাংলাদেশে রমনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট আকারে ইজতেমার আয়োজন চলছে। পরে টঙ্গীতে স্থায়ীভাবে ইজতেমা আয়োজন শুরুর পর এর পরিধি বেড়ে যায়, বিভিন্ন দেশের অতিথিদের আগমনের কারণে ১৯৬৭ সাল থেকে একে ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। আর জনসংখ্যার দিক দিয়েও টঙ্গীর ইজতেমায় তাবলীগ জামায়াতের সর্ববৃহৎ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

চ্যানেল আই অনলাইন

Back to top button