জমি ও খাবারের লোভে মায়ানমার যাচ্ছে উপজাতি বৌদ্ধরা

বিনামূল্যে জমি এবং খাবারের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বৌদ্ধদেরকে মিয়ানমারে যেতে প্রলুব্ধ করছে দেশটি। রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া স্থানে এসব বৌদ্ধকে পুনর্বাসন করতে চায় মিয়ানমার সরকার।

বান্দরবানের পার্বত্য অঞ্চল থেকে মারমা ও ম্রো গোষ্ঠির বেশ কয়েকটি পরিবার এরই মধ্যে মিয়ানমারে চলে গেছে।

বিশ্লেষকদের অভিমত, ‘বৌদ্ধরা অত্যাচার-নিপীড়ণের শিকার হয়ে বাংলাদেশ ছাড়ছে’ এমন অপপ্রচার চালাতে চায় মিয়ানমার।

সোমবার বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বরাতে এমনটি জানায় সংবাদ সংস্থা এএফপি।

বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেরা পার্বত্য ও বনাঞ্চল এলাকা থেকে প্রায় ৫০টির মতো পরিবার বিনামূল্যের ভূমি ও খাদ্যের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলে গেছে।

গত বছরের আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানের মুখে এই রাখাইন রাজ্য থেকেই প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

স্থানীয় কাউন্সিলর মুইং সোয়ি থোয়ি এএফপিকে জানান, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বাসা ছেড়ে চলে গেছে মারমা ও ম্রো গোষ্ঠির পরিবার। গত মাসে সাঙ্গু সংরক্ষিত বণাঞ্চলের গ্রাম থেকে ২২টি পরিবার চলে গেছে।

“এই পরিবারগুলো প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কিন্তু এদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কয়েকজনও রয়েছেন। বিনামুল্যে ভূমি, নাগরিকত্ব এবং ৫ বছরের জন্য বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হবে, তাদের রাখাইনে যেতে এমন প্রলোভন দেখিয়েছে মিয়ানমার।”

মুইং সোয়ি থোয়ি আরও বলেন, “মিয়ানমার ছেড়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফাঁকা করে যাওয়া জমিগুলো পূর্ণ করার জন্যই তারা সেখানে যাচ্ছে। এরা অত্যন্ত গরীব।”

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চুক্তি হলেও এখনপর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে দেশ দুটি এখন তালিকা বিনিময় করছে।

প্রথম দফায় বাংলাদেশ যে ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা দিয়েছে, তারমধ্যে মাত্র সাড়ে পাঁচশ জনের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার ছাড়পত্র দিয়েছে। মিয়ানমার ফেরত নেয়ার কোন সময় এখনও দেয়নি।

তবে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের নেতৃত্বে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় দফায় দশ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিতে পারে।

রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, নিজেদের গ্রামে ফেরার অনুমতি না দিলে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে না। এই গ্রামগুলোর অধিকাংশই নিরাপত্তা বাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে। সাময়িক পুনর্বাসন ক্যাম্পগুলোতে যেতে অনীহ রোহিঙ্গারা।

বাংলাদেশ সরকারের দুইজন কর্মকর্তা এএফপিকে এই অভিবাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বলে জানায় সংবাদ সংস্থাটি। তারা জানায়, প্রায় ৫৫টি উপজাতি পরিবার মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছে।

বাংলাদেশের একজন জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম এএফপিকে বলেন, মিয়ানমারের কয়েকজন বাসিন্দা বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে বাড়ি, ৫ থেকে ৭ বছরের জন্য বিনামূল্যের খাবারের লোভ দেখিয়েছে। কিছু পরিবার এই প্রস্তাবে আকৃষ্ট হয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে।

তিনি বলেন, এই উপজাতি পরিবারগুলোর কয়েকজনের রাখাইনে আত্মীয় স্বজন রয়েছে এবং এই স্বজনেরা বাংলাদেশিদের নিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় ও ভাষাগতভাবে এই লোকদের মিল রয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ অতীতেই সেখানে আবাস গেড়েছিলো।

আরেক সরকারি কর্মকর্তা আল কায়সার এএফপিকে বলেন, সম্প্রতি আলীকদম শহর ছেড়ে মিয়ানমার সীমান্তে প্রবেশের সময় মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় একজন নিহত ও কয়েকজন  আহত হয়েছেন।

কর্মকর্তারা জানান, এই অভিবাসনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আমরা মনে করি হয়তোবা মিয়ানমার এই লোকদের ব্যবহার করে এমন কিছু সংবাদ প্রস্তুত করতে চায় যে, বাংলাদেশে বৌদ্ধরা অত্যাচার-নিপীড়ণের শিকার হচ্ছে এবং এ কারণেই তারা দেশ ছাড়ছে। একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে এমনটি জানান।

বাংলাদেশের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা এএফপিকে জানান, পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে, যাতে বিনামূল্যে খাবার, বাড়ি, গরু এবং নগদ অর্থ দেয়া হয়, মিয়ানমার হাজারো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাখাইনে পুনর্বাসিত করেছে।

মুইং সোয়ি থোয়ি বলেন, গত তিন বছরে উপজাতিদের শতাধিক পরিবার মিয়ানমার চলে গেছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের অনুপস্থিতির সুযোগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ পদ্ধতিগত সামাজিক পুনর্গঠন প্রকল্প চালাচ্ছে। সরকার বা সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা বা বেসরকারি অর্থায়নের মাধ্যমে চলা ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই এলাকা বদলে দেয়া হচ্ছে। এলাকাটিকে ‘ইসলামের অনুপ্রবেশের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেখছে সেনাবাহিনী।