জাতীয়

সরকারি প্রকল্পে চাকরিরতরা প্রতারিত হচ্ছে

নিউজ ডেস্ক: উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর চান সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তবে এর আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই তাদের বেশিরভাগেরই। এই সুযোগটি গ্রহণ করছে এক শ্রেণির প্রতারক। তবে তারা সুবেশি এবং সরকারের বিভিন্ন দফতরেই উচ্চপদে চাকরি করেন। তারা প্রকল্পে কর্মরতদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। আবার এসব প্রতারকের খপ্পরে পড়েই প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি রাজস্ব খাতে নেওয়ার দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনেও নামে। এতে বিব্রত হয় সরকার। প্রতারিত হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা দফতরের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জনবল নিয়োগ করা হয়। অনেক সময় আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমেও নিয়োগ করা হয় প্রকল্পের জনবল। অধিকাংশ নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদকাল পর্যন্ত নিয়োগকৃতদের চাকরির মেয়াদের বিষয়টি উল্লেখ থাকে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে নিয়োগ করা জনবলের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও এক শ্রেণির কর্মকর্তারা ওই জনবলকে তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে নিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। তাদের কাছ থেকে বাড়তি আর্থিক সুবিধাও নিয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের জনবলের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের বিষয়টি সরকারের নীতিমালায় না থাকার কারণে স্থানান্তর করা সম্ভব হয় না। তখন ওইসব অসাধু কর্মকর্তার চাপে প্রকল্পে চাকরি করা জনগোষ্ঠী চাকরি স্থায়ী করতে আন্দোলনে নামে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় এরা টাকা পয়সা খরচ করে প্রতারিত হয়ে বাড়ি ফেরে।

সম্প্রতি খুলনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত ৩ হাজার ৮২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি রাজস্ব খাতে আত্তীকরণের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে মার্চের শেষ সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন করার ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দ্বৈতনীতির সমালোচনা করে তা পরিহার করে দ্রুত উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিও জানানো হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এলজিইডি’র নিয়মিতকরণ থেকে বঞ্চিত এই ৩ হাজার ৮২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও মাস্টাররোলে সামান্য বেতনে কাজ করেছে। তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থায়ী করা প্রলোভন দেখিয়ে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছে।

এদিকে এক সূত্রে জানা যায় , একইভাবে যশোর মেডিক্যাল কলেজে (যমেক) আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত কর্মীদের সঙ্গে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। কর্মচারীদের দাবি, জনবল সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরকার সার্ভিস চার্জ বাবদ ১৫ শতাংশ টাকা দিলেও নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের কাছ থেকে জোর করেই বাড়তি টাকা আদায় করছে তারা। প্রতিবাদ করলেই ছাঁটাইয়ের হুমকি দেওয়া হয়, ফলে ক্ষোভ থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না ওইসব কর্মচারী।

যশোর মেডিকেল কলেজের কর্মচারীরা জানান, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির (এমএলএসএস, আয়া, পিওন, কুক, মশালচি, ক্লাম্বার, গার্ড, টেবিল বয় ইত্যাদি পদে) ৬৫ কর্মচারী দীর্ঘ ৫ বছর ধরে চাকরি করলেও তাদের চাকরির স্থায়িত্ব নেই। আর চাকরি যাতে বহাল থাকে, সে কারণে প্রতি মাসে তাদের বাধ্যতামূলক গুনতে হয়েছে নগদ ৫ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হচ্ছে পে চেকের মাধ্যমে। এমএলএসএস পদের কর্মচারী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘শুরু থেকেই আমি এখানে কর্মরত। প্রতি দুই বা তিন মাস পরপর বেতন পাই। চাকরি যাতে না যায়, সেই ভয়ে প্রতিমাসে ৫ হাজার করে টাকা দিয়ে আসছি।’

একই প্রতিষ্ঠানের অফিস সহায়ক শান্তা জানান, ‘১৪ হাজার ৪৫০ টাকা বেতন হলেও মাস শেষে আমাদের থাকে ৯ হাজার ৪৫০ টাকা। টাকা না দিলে পরের বছর চাকরি নবায়ন করা হবে না বলে হুমকি দেন সুপারভাইজার। সে কারণে বাধ্য হয়েই টাকা দিতে হচ্ছে।’

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্পের কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর এবং বদলি বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদা মিন আরা, উপপরিচালক শেখ মোতালিব, উপপরিচালক (পরিকল্পনা) ডা. রাজিব হাসান, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা রেজাউল করিম এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলামের নামেই উঠছে এই অভিযোগ। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের প্রলোভন দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, প্রকল্পে চাকরিরত কর্মচারী আইনে বলা হয়েছে, যেসব প্রকল্পের জনবল নিয়োগের আগে সরকার প্রচলিত নিয়োগবিধি, নিয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, শুধু ওই প্রকল্পের জনবল রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মচারীর ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। প্রকল্পে কর্মকর্তা বা কর্মচারীর চাকরি সন্তোষজনক হতে হবে। প্রকল্প শেষের পর কর্মচারী যদি সরকারি, স্ব-শাসিত সংস্থা করপোরেশন কিংবা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাহলে তাকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। প্রকল্পের কোনও কর্মচারী রাজস্ব বাজেটের পদ ছাড়া অন্য কোনও পদে অধিকার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার দাবি করতে পারবেন না। প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া কর্মচারীর পদ ও মর্যাদা রাজস্ব বাজেটের শূন্যপদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে তাকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। প্রকল্প সমাপ্তির পর রাজস্ব বাজেটে নিয়োগ লাভের আগ পর্যন্ত একজন কর্মচারী বা কর্মকর্তা অব্যাহতভাবে কর্মরত না থাকলে তিনি ওই সময়ের জন্য কোনও আর্থিক সুবিধাও দাবি করতে পারবেন না।

উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মচারীদের চাকরির মেয়াদ এ আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে যোগদানের তারিখ থেকে রাজস্ব বাজেটের পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগের আগ পর্যন্ত কর্মচারীর চাকরিকাল ধরা হবে। প্রকল্পের যে কোনও পদে স্কেলে বা গ্রেডভিত্তিক নিযুক্ত ব্যক্তি প্রকল্পের কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। আইনে রাজস্ব বাজেটের আওতায় প্রকল্পের কর্মচারীদের নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রাখা হয়েছে। প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটের পদে জনবল নিয়োগ দিতে হলে যে পদে নিয়োগ দেওয়া হবে, ওই পদে চাকরির যোগ্য কি না, তা যাচাই করে তারপর নিয়োগ দেওয়া হবে। সরকার নির্ধারিত সর্বশেষ কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সরকারি কর্মকমিশনের আওতাভুক্ত রাজস্ব বাজেটের পদে কমিশনের সুপারিশে এবং কমিশনের আওতার বাইরে রাজস্ব বাজেটের পদে বিভাগীয় পদোন্নতি অথবা বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগ দেওয়া যাবে।

আইনের ৯ ধারায় জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের বিষয়ে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে নিয়মিত করা কোনও কর্মচারীর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার চাকরি রাজস্ব বাজেটের পদে যোগদানের তারিখ থেকে গণনা করা হবে। উন্নয়ন প্রকল্পে একই তারিখে নিয়োগ পাওয়া একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়োগের সময় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তুত করা মেধাতালিকা এবং গ্রেডিংয়ের ভিত্তিতে হবে। অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতা পাবেন অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের বছর একই হয়ে গেলে বয়সের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতা পাবেন। প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়মিত হওয়া কর্মচারী এবং নিয়মিতভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের চাকরিতে যোগদানের তারিখ এক হলেও নিয়মিতভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীরা জ্যেষ্ঠতা পাবেন।

আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের চাকরিকালে তার বেতন, ছুটি, পেনশন এবং গ্র্যাচুইটি ও সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে জারি করা গেজেটে নির্ধারিত সুবিধাদির ক্ষেত্রে গণনা করা হবে। আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইন কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে এর অধীনে নিয়োগকৃত কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আপাতত বলবৎ অন্য কোনও আইন, বিধি, প্রবিধান, প্রজ্ঞাপন, আইনগত দলিল, চুক্তি, আদালতের রায়, আদেশ বা নির্দেশে উল্লিখিত বা প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা কার্যকর হবে না এবং তা কোনওভাবেই বলবৎযোগ্য হবে না।

রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দুইটি বিষয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে—নিয়মিতকরণের আগের চাকরির ধারাবাহিকতা এবং সন্তোষজনক চাকরি। রাজস্ব বাজেটের পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত অথবা পদায়নকৃত কোনো কর্মচারী অবসরোত্তর ছুটি ভোগরত অবস্থায় অথবা অবসর গ্রহণ করলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে তাকে ভূতাপেক্ষভাবে নিয়মিত করা যাবে।

তবে আইনের এই ধারায় প্রকল্প থেকে আত্তীকৃত কর্মচারীদের আপত্তি রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পভুক্ত কয়েকজন কর্মচারী বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এরই মধ্যে যেসব বিষয় মীমাংসা হয়ে গেছে, আইন ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা আমলে না নিয়ে নতুন করে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আইন করছে।

আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, আইনটি কার্যকরে কোনও ধরনের অসুবিধা দেখা দিলে অসুবিধা দূর করার জন্য সরকার এ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আদেশ জারি করতে পারবে। এ আইনের অধীনে বিধি প্রণয়ন করবে সরকার। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবৎ আইন, বিধি, প্রবিধান, প্রজ্ঞাপন, আইনগত দলিল, চুক্তি, আদালতের রায়, আদেশ বা নির্দেশে ভিন্নতর যা থাকুক না কেন, উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মচারীদের নিয়োগ, নিয়মিতকরণ, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণসহ তাদের কর্মের শর্ত এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে এ আইন কার্যকর হবে, এর বাইরে নয়।

Back to top button