অর্থ-বাণিজ্য

যে কারণে হতদরিদ্রের হার কমেছে

Image result for দরিদ্র সুচক

দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি আগের চেয়ে এখন চাঙ্গা হয়েছে। গ্রামে এখন ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিবহির্ভূত ছোট ছোট নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থান করে নিয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হওয়ায় গ্রামের মানুষের হাতে টাকা সরবরাহ বেড়েছে। শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। ছোট পরিবারের সফলতা এসেছে। অনেকেই মাছ ও হাঁস-মুরগির খামার, চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, মুদি দোকান গড়ে তুলে আত্মকর্মসংস্থান করছেন। আগের তুলনায় গ্রামের মানুষের ভোগব্যয়ও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সাত বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ হতদরিদ্র মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে হতদরিদ্রের হার কমেছে। এই প্রবণতাকে ‘অর্জন’ হিসেবে মনে করে বিশ্বব্যাংক।

বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমানও। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার কারণে মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে কৃষি ও এসএমই খাতের উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ও শিক্ষার উন্নয়নও হতদরিদ্রের হার কমাতে সহায়তা করেছে। এর বাইরে ব্যাংকগুলোর সিএসআর কার্যক্রম ও সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম দরিদ্রের হার কমাতে সহায়ক ছিল।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেনও মনে করেন, ‘কৃষি ও এসএমই খাতের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতির ফলে হতদরিদ্রের হার কমেছে।’ তিনি  বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়ন, ছোট পরিবারের সফলতা, কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টির ফলে হতদরিদ্রের হার কমেছে। এছাড়া সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর যে কৌশল হাতে নিয়েছে তার সুফল এটি। এক্ষেত্রে এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়ন ও কৃষি খাতের উন্নয়ন সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এরও একটা সুফল এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘হতদরিদ্রের হার কমার আরেকটি কারণ, গত কয়েক বছর ধরে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। এর ফলে এইসব জায়গায় চাকরির সুযোগ বেড়েছে। মানুষের আয়ও বেড়েছে।’

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, গত অর্থবছর শেষে অতিদরিদ্রের হার দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে মোট জনসংখ্যার সাড়ে ১৮ শতাংশ ছিল চরম দরিদ্র মানুষ। গত সোমবার ‘টেকিং অন ইন-ইকোয়ালটি’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ৮০ লাখ হতদরিদ্র লোক ছিল। চলতি অর্থবছরে তা ২ কোটিতে নেমে এসেছে। যারা প্রতি মাসে ১ হাজার ২৯৭ টাকাও আয় করতে পারেন না।

দারিদ্র্য পরিস্থিতি তুলে ধরতে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, ওই বছর সরকারি হিসাবে অতিদরিদ্রের হার ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যা বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনের প্রায় কাছাকাছি ।

সোমবার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করেছে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখছে।

প্রসঙ্গত, সরকার গেল কয়েক বছর ধরে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনকে বেশি জোর দিয়েছে। এছাড়া উন্নয়নবান্ধব ও দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়ক বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সাল থেকে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন অভিযান শুরু করে। এছাড়া এসএমই ও কৃষি খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়।

এ প্রসঙ্গে ড. আতিউর রহমান জানান, ‘দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ২০০৯ সালে কৃষি খাতের ওপর জোর দেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে সেই বছর ৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কৃষিতে যারা ভালো করেছে তারাই মূলত দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়ক হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই কৃষি ঋণের টাকা কৃষকের হাতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রায় দেড় কোটি কৃষক ব্যাংক হিসাব খুলতে পেরেছেন। এই দেড় কোটি কৃষক কৃষি ঋণ ছাড়াও রেমিটেন্স পেয়েছেন।’

ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘২০০৯ সালে কৃষি খাতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা এসএমই খাতের উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হওয়াতে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ দ্রুত অর্থ হাতে পেয়েছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, আমি একটা বিশ্ব মন্দার ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দায়িত্ব পেয়েই আমি বাংলাদেশের মানুষদের এই মন্দা থেকে বাঁচানোর জন্য একটা ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন অভিযান শুরু করেছিলাম। ব্যাংকগুলো সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে এতে সাড়া দিয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু সৃজনশীল উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছিল যেগুলো তারা বাস্তবায়ন করেছে। আজও তারা করে যাচ্ছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button