বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রহস্যময় শনির হিম শীতল চাঁদ এনসেলেডাস


পানির অপর না হয় জীবন। কিন্তু প্রাণের অপর নাম কী? প্রাণের জন্য কি কি প্রয়োজন? আমরা যেটা প্রাণ বলে ধরে থাকি তার জন্য তিনটি আবশ্যক জিনিস প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে পানি, শক্তি এবং রসায়ন বা রাসায়নিক বন্ধন। যদি বলি এগুলো পৃথিবী ছাড়াও পাওয়া গেছে এবং তা আমাদের খুব কাছেই তাহলে খুব অবাক হবেন? অবাক না হয়ে বরঞ্চ চলুন ঘুরে আসি, শনি গ্রহের হিম শীতল চাঁদ এনসেলেডাস থেকে।

নাসার স্পেসক্রাফট ক্যাসিনি নিশ্চিত করেছে যে, শনির এই চাঁদে প্রাণের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই পাওয়া যাবে। ক্যাসিনি যখন শনির চারপাশে ঘুরছিল তখন এর সেন্সর এনডেসেলাসের দক্ষিণ মেরুতে গ্যাসের উষ্ণ প্রস্রবণের উৎক্ষেপণ শনাক্ত করে। বিশ্লেষণ করে জানা গেছে এর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া এবং মিথেেনের উপস্থিতি রয়েছে।

কেউ যদি এগুলো দেখে মনে করেন সেখানে গিয়ে আরামসে ছুটি কাটিয়ে আসবেন তাহলে ভুল করবেন। এর বরফের তৈরি খোলসে নিচে রয়েছে তরল সমুদ্র। অক্সিজেনের পরিমাণও খুব কম। আর বরফের নিচে পুরটাই অন্ধকার, কারণ এর বরফের খোলস সূর্যের অধিকাংশ আলো প্রতিফলন করে ফিরিয়ে দেয়।

 

এনসেলেডাসের গঠন

উপরের পৃষ্ঠ হাড় কাঁপানো হিম শীতল ঠাণ্ডা হলেও এর নিচের পানির তাপমাত্রা ৮৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলে অনুমান করছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও এর আবহাওয়া খুবই নেতিবাচক, জীবনের জন্য তবুও সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এখানে সেই সকল জীব বেঁচে থাকতে পারবে যা পৃথিবীর কঠিনতম পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত। অস্ট্রিয়া এবং জার্মানির একদল গবেষকদের নতুন রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, পৃথিবীতে সমুদ্রের নিচে যেসকল আগ্নেয়গিরি আছে তাদের চারপাশে বেঁচে থাকা প্রাণীরা এনসেলেডাসের পরিবেশ সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারবে।

আমরা গবেষণাগারে এনডেসেলাসের মতো পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছি, বলেন অস্ট্রিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনারর আর্কিয়া অণুজীব গবেষক সাইমন রিটম্যান। আর্কিয়া হলো এককোষী অণুজীব। মাইক্রোস্কোপের নিচে তাদেরকে দেখতে অনেকটা ব্যাকটেরিয়ার মতো লাগে। তবে ব্যাকটেরিয়ার মতো মনে হলেও তারা আলাদা। পানির নিচের আগ্নেয়গিরির আশেপাশে এরা থাকে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান তাদের খাদ্য।

আর্কিয়ার গঠন

রিটম্যান এবং তার সহকর্মীরা বেশ কয়েকটি চেম্বারে এনসেলেডাসের মতো পরিবেশে তৈরি করে সেখানে তাদের পরীক্ষা করেছেন। এর মধ্যে তারা আবার সকল কেমিক্যাল এবং আনবিক হাইড্রোজেন রেখেছিলেন। বিজ্ঞানীরা এ পরীক্ষা করতে গিয়ে এনসেলেডাসের অনিশ্চিত পরিবেশের কথা চিন্তা করে পরীক্ষার বিভিন্ন উপাদানের তারতম্য করেছেন। যেমন আনবিক হাইড্রোজনের পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিয়েছেন,পানির ক্ষারত্ব পরিবর্তন করেছেন অথবা গ্যাসের পরিমাণের পরিবর্তন করেছেন।

রিটম্যান বলেন, আমরা যতটা সম্ভব পরিবেশের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। কারণ আমরা আসলেই জানি না যে এনসেলেডাদের বরফের নিচে কী আছে। তিনি আরো বলেন, আর এই কারণেই আমরা যতটা সম্ভব সাবধান হওয়ার চেষ্টা করেছি।

এই পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হয়ে গেলে এনসেলেডাসে Methanothermococcus okinawensiপ্রজাতির আর্কিয়ন পাঠানো হবে। বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতিটিকে জাপানের ওকিনাওয়ায় পানির ৩০০০ ফিট নিচে আবিষ্কার করেছেন। এই প্রজাতিটি কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং আণবিক হাইড্রোজেন দুটোই গ্রহন করে। এনডেসেলাসের কোনো অনুজীবেরও এরকম উপাদানই গ্রহণ করার কথা। এ প্রজাতিটি এরকম পরিবেশে শুধু লড়াই করে বেঁচে আছে তা কিন্তু নয়। এর ওপরে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করেও দেখা হয়েছে এতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি উল্টো সে মিথেন গ্যাস তৈরি করে ফেলেছে। এনডেসেলাসে এই ধরনের একই প্রজাতি হয়ত বলতে পারবে কেন এই উপগ্রহে মিথেন সহজলভ্য।

এত কিছুর পরেও কিছু বাঁধা থেকেই যায়। নাসার স্পেসক্রাফট ক্যাসিনি এনসেলেডাসে ফরমালডিহাইড এর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছে যা সবচেয়ে কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকা আর্কিয়ার জীবনচক্রে বাঁধা দিয়ে বসবে। M. okinawensi কিছু মাত্রা পর্যন্ত ফরমালডিহাইড সহ্য করতে পারে। কিন্তু ক্যাসিনি এনসেলেডাসে যেই মাত্রায় দেখেছে সেই মাত্রা প্রয়োগ  করার পর এই প্রজাতিটি বেঁচে থাকতে পারেনি। রিটম্যান মনে করেন এটা শুধুই একটা ধারণা। সেখানে পানির নিচে অন্যরকম হাইড্রোথার্মাল ব্যবস্থা থাকতে পারে যেখানে হয়ত প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব।

তিনি আরো বলেন আমরা যেগুলো চিন্তা করছি সেগুলো শুধু চিন্তাই হতে পারে। এমনও হতে পারে যে এনসেলেডাসে যেই মিথেনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তা জৈবিক কারনে তৈরি নাও হতে পারে। অজৈবিক অনেক উপায়ে মিথেন তৈরি হওয়া সম্ভব। তাই এ ব্যাপারে চাই আরো বড় পদক্ষেপ। আরো বড় পরীক্ষা। সবাই দেখতে চায়-জানতে চায় আসলে কি আছে এই অন্ধকার সমুদ্রের নিচে।

 

 

Back to top button