আন্তর্জাতিক

সু চি কি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠবেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেসামরিক সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’র সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের প্রথম আভাস মেলে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযানকে কেন্দ্র করে। সেনাবাহিনীর দাবি, সশস্ত্র ওই গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে দেওয়া নির্দেশনাটি ছিল সু চি’র। বেসামরিক প্রশাসন সরাসরি এ অভিযোগ নাকচ না করলেও নির্দেশনাটি সু চি’র কিনা, তা নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। দুই বছর আগে সেনাবাহিনীর ইন্ধনে খুন হওয়া ঘনিষ্ঠ সহযোগীর প্রশ্নে এতদিন নীরব থাকলেও সম্প্রতি সত্য উন্মোচনের ডাক দিয়ে পরোক্ষেভাবে সু চি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

সেনা-সু চি দূরত্বের বিষয়টি স্পষ্টভাবে সামনে আসে এনএলডি’র সংবিধান সংশোধনের আকস্মিক উদ্যোগকে কেন্দ্র করে। সেনানিয়ন্ত্রিত সংবিধান সংশোধনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে সে দেশের সামরিক বাহিনী। এদিকে, বিতর্কিত বাঁধ নির্মাণ প্রশ্নে সু চি এরইমধ্যে চীনের সঙ্গে আপসরফা করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা তাই চীনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সু চি’র সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগকে ‘মোক্ষম সময়’ মনে করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠবেন কিনা, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবসে মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের ফাঁড়িতে হামলা চালায় আরাকান আর্মির সদস্যরা। ১৮ জানুয়ারি (শুক্রবার) নেপিদোতে এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দাবি করে, ৭ জানুয়ারি বৈঠকে আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন সু চি। তবে সু চি’র নামে সেনাবাহিনী যে বক্তব্য হাজির করেছে, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হয়নি প্রেসিডেন্ট দফতর। ১৯ জানুয়ারি (শনিবার) সাংবাদিকদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট দফতরের মহাপরিচালক উ জাও তায় জানান, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে জমা দেওয়ার জন্য একটি নথি তৈরি করা হয়েছে। ওই নথিকে ‘বিশেষায়িত তথ্য’ (প্রিভিলেজড ইনফরমেশন) আখ্যা দিয়ে তিনি জানান, এ নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। প্রেসিডেন্ট দফতরের এই অবস্থান নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানার চেষ্টা করে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী। তবে সেনা-মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়নি তারা।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক ও মিয়ানমার বিষয়ক স্বাধীন পরামর্শক হান্টার মার্স্টন ইরাবতীকে বলেছেন, ‘বাস্তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেসামরিক নিয়ন্ত্রণের আওতাধীন নয়, তারা স্বনিয়ন্ত্রিত। আমার খুবই সন্দেহ হচ্ছে— আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বড় মাপের দমন অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্তটি সেনাবাহিনীর। এনএলডির বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে সিদ্ধান্তটি সমর্থন না করার কোনও সুযোগ ছিল না।’ আর আরাকান আর্মিকে নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্তটি সু চি’র নামে হাজির করার প্রসঙ্গে ইয়াঙ্গুনের একজন সাংবাদিক ‍উ থিহা থোয়ে বলেন, ‘সেনাবাহিনী দেখাতে চায় যে, তারা সু চি নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন এবং সব নিয়ন্ত্রণ সু চি’র কাছে।’

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্দোনেশিয়া থেকে ফেরার পথে ইয়াঙ্গুন বিমান বন্দরে হত্যার শিকার হন মিয়ামনারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’র ঘনিষ্ঠ সহযোগী আইনজীবী উ কো নি। গত বছর ডিসেম্বরে রয়টার্স প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হত্যার মাসখানেক সময়ের মধ্যেও এ বিষয়ে কোনও প্রতিবাদ করেননি সুচি। কো নি’র সৎকার অনুষ্ঠানেও যাননি তিনি। তাকে সমবেদনা প্রকাশ করতে দেখা যায় হত্যাকাণ্ডের মাসখানেক পর সু চি’র এনএলডি’র এক স্মরণসভায়। প্রকাশ্য জনসভায় তিনি কো নি-কে তার পরামর্শদাতা ও সহযোগী হিসেবে স্মরণ করলেও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রশ্নে নীরবতা পালন করেন। এতদিন নীরব থাকলেও ২৯ জানুয়ারি ( মঙ্গলবার) সু চি বলেছেন, ‘কো নি হত্যাকাণ্ডের সত্য উন্মোচিত হতে হবে।’

কথিত গণতান্ত্রিক উত্তোরণের নামে মিয়ানমারে আদতে জারি রয়েছে সেনাশাসন। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের যে কোনও প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস হতে হলে ৭৫ শতাংশের বেশি সমর্থন প্রয়োজন। অথচ দেশটির পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছেন সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা। গণতান্ত্রিক সরকার বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এনএলডি’র অন্যতম নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল এই সংবিধান সংশোধন করা। তবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় তিন বছর পর ২৯ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো সু চি’র দলের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে সু চি’র সরকার ক্ষমতায় আসার পর এমন পদক্ষেপ এটাই প্রথম।

ডিপ্ল্যোম্যাটের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এবারের সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি সামনে এসেছে ২০২০ নির্বাচনকে ঘিরে এবং দেশটি বৃহৎ রাজনীতিতে এনএলডি সরকারের অবস্থান প্রশ্নে এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর সু চি নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার সংবিধানের বেশকিছু সংশোধনের অঙ্গীকার করেছে। আর চলতি সপ্তাহে প্রথমবারের মতো এনএলডিকে সেই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। ডিপ্ল্যোম্যাট বলছে, জয়লাভের পর এনএলডি সরকার খুব সতর্কতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, গত নভেম্বরে উপ-নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় তারা এখনও সমর্থন জোরালো করার চেষ্টা করছেন। সেজন্য নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার লক্ষ্য তাদের। ২০১৯ সাল সেটা করার জন্য সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ ২০২০ সালেই জাতীয় নির্বাচন। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই মুহূর্তে এনএলডি প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রভাব খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে এর প্রশ্নাতীত তাৎপর্য রয়েছে। স্পষ্টত কমিটি গঠনের প্রস্তাব পাস হওয়ার বিষয়টি তথা আইনপ্রণেতাদের ভোট জেতার সাফল্য প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, সরকাররের কাঠামোবদ্ধ কৌশল হিসেবে এনএলডি একেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সীমিতকরণের পথ হিসেবে নিয়ে সামনে এগোতে পারে।

সংবিধান সংশোধনে কমিটি গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার অনুমোদনই যথেষ্ট ছিল। ডিপ্লোম্যাট বলছে, সে কারণেই প্রস্তাবটি পাস হতে পেরেছে। তবে এতেই প্রমাণ হয় না যে সংশোধনী আসবেই। কারণ, সেটার জন্য ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট প্রয়োজন, আর সামরিক বাহিনীর কাছে ২৫ শতাংশ আসন রয়েছে। সামরিক বাহিনীও নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করে চলেছে। এমনকি সংসদীয় কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছেন সামরিক আইনপ্রণেতারা। তারা এমনও অভিযোগ করেছেন যে, আইনি ক্ষমতার অপব্যাহার হচ্ছে। তবে এটা এখন পরিষ্কার যে সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে মিয়ানমারে সামরিক-বেসামরিক সরকারের মাঝে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হবে।

সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে এনএলডি সরকারের আসলেই কী পরিকল্পনা সেটা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কারও। ডিপ্লোম্যাট বলছে, কমিটি গঠনের পর এবার সংশোধনের বিষয়বস্তু ও মাত্রাগত দিক নিয়ে দুই পক্ষের বাদানুবাদ হবে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মাঝে ক্ষমতার বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে মীমাংসা কঠিন। আর মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে সামরিক ক্ষমতা ও সু চি’র ক্ষমতার।

ডিপ্লোম্যাট আরও জানায়, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‍সু চি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলেও আন্দোলনের মুখে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে তার। অভিযোগ উঠতে পারে যে, এনএলডি সরকার জনগণ ও দেশের কথা না ভেবে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। তাই এনএলডি দুইদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে ২০২০ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। তবে কী হবে সেটা, নিশ্চিত করে বলার তো সময় এখনও আসেনি।

ইরাবতিতে লেখা এক নিবন্ধে কলামিস্ট জোয়ে কুমবুন মন্তব্য করেছেন, চীনের সঙ্গে বিতর্কিত এক বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে সম্মতি দিয়ে সু চি তাদের সঙ্গে আপসের রাজনীতিতে গেছেন। বাঁধ নির্মাণ প্রশ্নকে তিনি বাজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন চীনের সঙ্গে। মিয়ানমারের রাজনীতিতে চীনের আধিপত্যকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংশোধনের সম্মতি আদায় করে নিতে পারেন। তিনি বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে মোক্ষম সময়েই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সু চি’র দল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি পেরে উঠবেন কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।

Back to top button