জাতীয়

১০ বছরে ঢাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ২০০ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০১০ সালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ভাড়া বাসায় ওঠেন ইসমাইল হোসেন। শুরুতে দুই রুমের ওই বাসার ভাড়া ছিল তিন হাজার ২০০ টাকা। এখনও ওই বাসাতেই থাকেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ইসমাইল। এখন তাকে মাসে ভাড়া গুণতে হচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ইসমাইল হোসেনের বাসাভাড়া বেড়েছে ১৯৭ শতাংশ।

ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘চাকরি করে যা আয় করি তার বেশিরভাগই চলে যায় বাসাভাড়ায়। শুরুতে বাসাভাড়ার সঙ্গে পানির বিল, গ্যাস বিল ও বিদ্যুৎ বিল অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন এই তিনটি বিলই আলাদা দিতে হয়। এসব বিল হিসাবের মধ্যে নিলে দেখা যাবে গত ১০ বছরে বাসাভাড়া চারগুণ বেড়ে গেছে।’

ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের ৮০ শতাংশের ওপরে ভাড়াটিয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও তারাই সবথেকে বঞ্চিত। প্রতিবছর বাড়িভাড়া বাড়িয়ে বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়াদের শোষণ করছেন। কেউ কিছু বলতে গেলে নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়।

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে একই বাড়িতে আছি। বাড়ির মালিকও পরিচিত, সম্পর্কও ভালো। তাই অন্যত্র চলে যাইনি। কিন্তু প্রতিবছরই জানুয়ারি মাসে ভাড়া বেড়েছে। তবে করোনার কারণে এবার (২০২১) ভাড়া বাড়াননি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আমাদের বাসা না, যাত্রাবাড়ীর সব বাসারই ভাড়া বেড়েছে। দু’বার বাড়ি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখি, আমাদের বাসা থেকে অন্যান্য বাসার ভাড়া আরও বেশি। ফলে বাধ্য হয়েই বাসা মালিকের ভাড়া বাড়ানো মেনে নিয়ে থেকে গেছি।’

শুধু ইসমাইল হোসেন বা যাত্রাবাড়ীর দৃশ্য নয় এটি, ঢাকা শহরজুড়েই গত কয়েক বছরে এভাবে বাড়িভাড়া বেড়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল এই সময়ের মধ্যে ঢাকায় দুই রুমের পাকা বাসার ভাড়া ১১৮ শতাংশ, আধাপাকা (টিন শেডের) বাসা ভাড়া ৯৫ শতাংশ, মেস বাড়ির ভাড়া ১০২ শতাংশ এবং বস্তিতে ভাড়া ১৭৪ শতাংশ বেড়েছে।

গত বছর থেকে মাসে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা করে পানির বিল দিতে হচ্ছে। বাড়িওয়ালা বলেন, ওয়াসা পানির বিল বাড়িয়েছে। হয়রানির শিকার হতে হবে এই ভেবে কিছু না বলেই মুখ বুজে সব সহ্য করে নিচ্ছি।

এদিকে, ছোট এই ঢাকা শহরে দুই কোটির ওপরে মানুষের বসবাস। এর মধ্যে কত সংখ্যক মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন এবং কত সংখ্যক মানুষ নিজস্ব বাড়িতে থাকেন, সে সংক্রান্ত কোনো জরিপ কারও কাছে নেই। তবে ধারণা করা হয়, ঢাকায় বসবাসকারীদের ৮০ শতাংশের ওপরে ভাড়াটিয়া।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে দুই লাখ ৫১ হাজার ৩০২টি হোল্ডিং (আবাসিক এবং বাণিজ্যক) রয়েছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং রয়েছে তিন লাখ ৩৮ হাজার। সে হিসাবে দুই সিটিতে হোল্ডিং আছে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার।

ঢাকা শহরে বাড়াটিয়ার সংখ্য কত- তার তথ্য না থাকলেও ক্যাবের তথ্য অনযায়ী, ২০১০ সালে দুই কক্ষের পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৩০০ টাকা। বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে তা ২৪ হাজার ৫৯০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ে পাকা বাসার গড় ভাড়া বেড়েছে ১৩ হাজার ২৯০ টাকা। আধাপাকা (টিন শেড) বাড়ির দুই কক্ষের ভাড়া ২০১০ সালে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা, যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে।

একইভাবে বেড়েছে মেস ও বস্তির বাড়ি ভাড়া। ২০১০ সালে দুই কক্ষের মেসের গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৫০০ টাকা, যা বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ২৩ হাজার ২০০ টাকা। এ হিসাবে গড়ে মেসভাড়া বেড়েছে ১১ হাজার ৭০০ টাকা। আর ২০১০ সালে বস্তির দুই কক্ষের ভাড়া ছিল তিন হাজার ৯০০ টাকা, যা বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ১০ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ বস্তির দুই কক্ষের গড় ভাড়া বেড়েছে ছয় হাজার ৮০০ টাকা।

এ থেকে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে ঢাকার সব শ্রেণির বাড়ি ভাড়া বেড়েছে। তবে অন্যদের তুলনায় নিম্ন আয়ের মানুষ বা যারা টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাদের ওপর চাপ বেশি পড়েছে। কারণ গত কয়েক বছরে ঢাকার টিনশেড বাড়ির ভাড়া বেড়েছে সবথেকে বেশি।

রামপুরার একটি টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন মো. আলী হোসেন। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে দুই রুম ভাড়া নিয়ে এই বাড়িতে উঠি। প্রথমে দুই রুমের ভাড়া ছিল ছয় হাজার টাকা। এখন সাড়ে আট হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এভাবে বাড়িভাড়া বাড়লেও আয় বাড়েনি। বরং করোনার কারণে এখন আয় কমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে ২০১৩ সাল থেকে রিকশা চালানো শুরু করি। প্রথমে ঢাকায় একা থাকতাম। পরে পরিবার নিয়ে এসেছি। আগের মতোই এখনো রিকশা চালাই। করোনার আগে দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হতো। করোনার কারণে আয় কমে গেছে। কিন্তু খরচ কমেনি। সবমিলিয়ে আমরা এখন বেশি কষ্টে আছি। বাড়িভাড়া যদি কিছু কম হতো তাহলেও কিছুটা কষ্ট লাঘব হতো।’

বাড্ডায় একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন মো. ইউসুফ। মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করা ইউসুফকে মাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় ১৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বেতনের প্রায় অর্ধেক তাকে ভাড়া বাবদ ঢালতে হয়।

ইউসুফ বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়ে না, কিন্তু প্রতিবছরই বাসাভাড়া বাড়ে। মাসে যে বেতন পাই তার প্রায় অর্ধেক বাসাভাড়া দিয়ে দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাই। মানুষ শুধু আয় দেখে, ব্যয় দেখে না। আমরা যে কী কষ্টে ঢাকায় টিকে আছি তা বলে বোঝানো যাবে না।’

রামপুরার ভাড়াটিয়া অমরেশ বলেন, ‘চার বছরের এক ছেলেসহ আমরা তিনজন থাকি। প্রতিমাসে দুইরুম বিশিষ্ট বাসার ভাড়া দেয়া লাগে ১০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল আলাদা দেয়া লাগে। বাসার মালিক প্রথমে বলেছিলেন, পানির বিল দেয়া লাগবে না। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই পানির বিল ৫০০ টাকা করে ধরা শুরু করেন। এরপর গত বছর থেকে মাসে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা করে পানির বিল দিতে হচ্ছে। বাড়িওয়ালা বলেন, ওয়াসা পানির বিল বাড়িয়েছে। হয়রানির শিকার হতে হবে এই ভেবে কিছু না বলেই মুখ বুজে সব সহ্য করে নিচ্ছি।’

ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জান্নাত ফাতেমা বলেন, ‘ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের ৮০ শতাংশের ওপরে ভাড়াটিয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও তারাই সবথেকে বঞ্চিত। প্রতিবছর বাড়িভাড়া বাড়িয়ে বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়াদের শোষণ করছেন। কেউ কিছু বলতে গেলে নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের হিসাবে গত ১০ বছরে ঢাকার বাড়িভাড়া বেড়েছে তিনগুণের ওপরে। এর সঙ্গে বিভিন্ন চার্জও বেড়েছে। সবমিলিয়ে ঢাকার ভাড়াটিয়ারা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। বাড়ির মালিকরা সবকিছু তাদের ইচ্ছামাফিক করছেন। তারা কোনো কিছুর ধার ধারেন না। এমনকি ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে ভাড়ার কোনো চুক্তিও করেন না। অধিকাংশ বাড়ির মালিক ভাড়ার বিল দেন সাদা কাগজে লিখে। তারা বাড়ি ভাড়ার কোনো রশিদও দেন না। কোনো ভাড়াটিয়া এসব নিয়ে কথা বললে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। এ সমস্যা থেকে বের হতে হলে ভাড়াটিয়াদের একজোট হতে হবে। সম্মিলিত প্রতিবাদ করতে হবে।’

Back to top button