জাতীয়

১১ লাখ পথশিশু নিয়ে দুশ্চিন্তা

 অর্ধেক মাদকাসক্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে পথশিশুদের অবস্থার নিয়ে পুলিশ বলছে, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ১১ লাখ পথশিশু কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত। তাদের প্রায় অর্ধেক মাদকাসক্ত। পুনর্বাসন না করলে এই পথশিশুদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাদের মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য পুলিশ বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, দেশ থেকে অপরাধ নির্মূল করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কাজ করছে। যেসব পথশিশু অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, যেসব শিশুর জন্য রাস্তা বসবাসের স্থান অথবা জীবিকার উপায় হয়ে গেছে, তাদের পথশিশু বলা হয়।

গত বছর ৩১ অক্টোবর দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে পথশিশুর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সরকারিভাবে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। কারা পথশিশু, সে বিষয়ে কোনো সংজ্ঞাও নির্ধারণ হয়নি এখনো।

পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর সংগঠন স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাকটিভিস্টস নেটওয়ার্ক-স্ক্যানসহ বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অভিক্ষেপণের ভিত্তিতে জানায়, সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি।

পথশিশুদের নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিদেশী বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু এই শিশুদের পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনে কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রতিটি শিশুই স্কুলে যাবে। একটি শিশুও ঝরে পড়বে না, রাস্তায় ঘুরবে না, টোকাই হবে না। তারাও স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে। বিষয়টি তদারকি করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর পথশিশুদের পুনর্বাসনে কমলাপুর ও কারওয়ান বাজারে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, প্রায় এক বছর ধরে পুলিশ পথশিশুদের নিয়ে গবেষণা করেছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১১ লাখ পথশিশু কিছু না কিছু অপরাধের সঙ্গে স¤পৃক্ত বিশেষ করে মাদক কারবার, চুরি ও ছিনতাইয়ে জড়িত তারা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশালে অপরাধ হচ্ছে বেশি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার ২২৯টি স্থানে পথশিশুদের অপরাধ বেশি হচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে এলাকার কিছু ‘বড় ভাই’। ওই সব ‘বড় ভাইদের’ তালিকা করার কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীসহ সারা দেশে পার্ক, ফুটপাত, রেলস্টেশন, ফেরিঘাঁট, লঞ্চ টার্মিনাল বা বাসস্টেশনে থাকে পথশিশুরা। তবে অর্ধেকেরই বাস রাজধানী ঢাকায়। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি, স্টেশনে শিশু-কিশোররা দলবদ্ধ হয়ে নেশা করে। পথশিশুরা গাঁজা, ডান্ডি ও প্যাথেড্রিনের মতো মাদকে আসক্ত। মাদককে কেন্দ্র করে কমপক্ষে এক ডজন খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর মাদকদ্রব্য গ্রহণের কারণে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত। ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্ত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে এবং মেয়েশিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচ- ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মেয়ে পথশিশুরা যৌনকর্মেও জড়িয়ে পড়ছে।

এ ছাড়া ৪১ শতাংশ পথশিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ অসুস্থ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারে না। ৩৪.৪ শতাংশ শিশু কোনো স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস অবস্থান করে। তাদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে স্থান পরিবর্তন করে। আর নিরাপত্তাকর্মীদের কারণে স্থান ত্যাগ করে ৩৩ শতাংশ শিশু। খোলা আকাশের নিচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নৈশপ্রহরী ও মাস্তানদের দিতে হয়।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। ঢাকার অন্তত ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯-১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। তা ছাড়া মিছিল-মিটিং, বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউন কিংবা হরতালের পিকেটিংয়ে পথশিশুদের ব্যবহার করা হয়। শোডাউন ছাড়াও পিকেটিং, ভাঙ্গচুর কিংবা ককটেল নিক্ষেপের মতো বিপজ্জনক কাজে ব্যবহার হচ্ছে ওরা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আহসানুল জাবের বলেন, ‘মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। তারপরও তাদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। অভাবের তাড়নায় পথশিশুরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের সংশোধন করতে হলে পুলিশ ছাড়া বিকল্প নেই।’

জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে মহাখালীতে আরিফ হত্যাকান্ডের পর পুলিশ রাজধানীতে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের পুনর্বাসনের বিষয়ে কঠোর হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মুহম্মদ শফিকুল ইসলাম ঢাকার আট ক্রাইম বিভাগকে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে চার বিভাগে ৪৭ শিশু-কিশোরকে এই উদ্যোগের আওতায় আনা হয়েছে।

পুুলিশের গবেষণায় পথশিশুদের দুর্দশা তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশও করা হয়। বলা হয়, তাদের সংশোধন করতে হলে আটক করে ভবঘুরে পাঠানো দরকার। পাশাপাশি দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) পথশিশুদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে প্রায় ১০ বিঘা জমির ওপর মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে এই মাদক নিয়াময় কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়।

বর্তমানে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি ভবঘুরে কেন্দ্র আছে। মিরপুরে একটি তৈরি করা হচ্ছে।

কয়েকটি জেলার এসপি বলেন, পথশিশুদের ব্যবহার করা হয় মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। মেয়েশিশুদের অধিকাংশই অল্প বয়সে যৌনকর্মের মতো পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে বাধ্য হচ্ছে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম জানান, পথশিশুদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের কিছু করা উচিত। কারণ এরা অনেক অসহায়। তারা গরিব পরিবারের সন্তান। আবার তাদের মধ্যে কারও কারও মা-বাবাও নেই। অভিভাবক না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা রাস্তায় নেমে পড়ে। অপরাধ করে। না খেতে পেরে এরা অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, এই দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। বড় বড় কথা বললে হবে না। তাদের জন্য কাজ করে দেখিয়ে দিতে হবে সরকার তাদের পাশে আছে। সমাজকল্যাণ বা নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় তাদের জন্য কিছুই করছে না। এমনকি বেসরকারি সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসছে না। অনেক এনজিও সংস্থা মানবাধিকারের কথা বলে। অথচ এরা এই পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে না।

Back to top button