জাতীয়রাজনীতি

অপারেশন সার্চ লাইট ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা

95

তখনও জানে না কেউ কী ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় রাত সামনে তাদের। ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যস্ত শহর ঢাকা । অনেকে ঘুমিয়েও পড়েছে। হঠাৎই খুলে গেল নরকের সব ক’টি দরজা।
২৫ মার্চ মধ্যরাত। অন্ধকারে পাক জল্লাদ বাহিনী দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। হকচকিত বাঙালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাথ, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই লাশ আর রক্তস্রোত। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর।
মধ্যরাতে চলল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। পাকিস্তানী দানবরা মেতে উঠল বাঙালী নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেকস্থানেই মাত্র এক রাতেই নির্মমভাবে হত্যা করল অর্ধ লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালীকে।
হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি পিপলস ডেইলি, গণবাংলা, দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাব অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। নিহত হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মী।
মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাালয়ে ঢোকে ট্যাঙ্ক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) জগন্নাথ হল রোকেয়া হলে প্রতিটি রুমে রুমে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে । গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ হিন্দু ছাত্র। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে।
রক্ষা পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। চলার পথেও রাস্তার দুই পাশে চলতে থাকে ব্রাশফায়ার। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষ।
চারদিক রক্ত আর রক্ত, লাশ আর লাশ। হিংস্র শ্বাপদদের থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ ছাত্রী লাফ দিয়ে পড়েছিল। হত্যার পাশাপাশি চলছিল ধর্ষণ ও লুট। সেই রাতে রাজারবাগে নিহত হয় ১১শ’ বাঙালী পুলিশ। রক্তের স্রোতে ভেসে যায় রাজারবাগের সড়ক।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা
রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালীর মতোই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা সে রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলি হয়।
চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ষোলশহরে গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ ব্যুহ। ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রামে কর্মরত সিনিয়র অফিসার মেজর জিয়া তাঁর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে রওনা হন। পথে পথে বাঙালীর দেয়া ব্যারিকেড সরিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন।
এদিকে রাত ৯টার দিকেই পাক হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনানিবাসে বাঙালীদের ওপর। নির্বিচারে হত্যা করা হয় সহস্রাধিক বাঙালী সেনা ও তাদের পরিবারের সদস্যকে।
ক্যাপ্টেন রফিকের প্রতিরোধের সংবাদ এবং সেনানিবাসে হামলার ঘটনা ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান যখন মেজর জিয়ার সঙ্গে রাস্তায় ব্যারিকেড সরানো অবস্থায় দেখে ঘটনা খুলে বলেন, তখন মেজর জিয়া তাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে তিনি তার নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
মেজর জিয়া যখন রাত ১টার দিকে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন শমসের মবিনসহ অন্যদের মাঝে ফিরে আসেন ততক্ষণে পাক সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধও ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। এদিকে গাজীপুরেও সফিউল্লার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় তীব্র প্রতিরোধ। এরপর আর বীর বাঙালী পেছনে ফিরে তাকায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button