দেশের সংবাদ

শীতল পাটি : ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকায়

Image result for শীতল পাটি

বাংলাদেশের কোনো কোনো স্থানে শীতল পাটি তৈরির কথা জানা গেলেও মূলত শীতল পাটি হলো মেঝেতে পাতা একধরনের আসন। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প। মুর্তা বা পাটি, বেত বা মোস্তাক নামের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এ পাটি তৈরি হয়। হস্তশিল্প হিসেবেও এ পাটির যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো-পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর বা চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত মাদুরকে আবার নকশি পাটিও বলা হয়। সিলেট ছাড়া বৃহত্তর নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলে শীতল পাটি তৈরি হয়। বিশেষ করে শুকনা মওসুমে মুর্তা থেকে বেত তৈরি হয়। বর্ষা মওসুমে দীর্ঘ সময় নিয়ে যত্নসহকারে বোনা হয় শীতল পাটি। শীতল পাটিতে কারিগররা দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন গান, কবিতা, জীবজন্তুসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি। নকশা করা শীতল পাটি শৌখিন অনেকে গৃহসজ্জার কাজেও ব্যবহার করেন। আর বর-কনেকে শীতল পাটিতে বসিয়ে আপ্যায়নের রীতিও পুরনো।

বৃহত্তর সিলেট শীতল পাটির জন্য প্রসিদ্ধ। সিলেটের চার জেলার সব ঘরে শীতল পাটি তৈরি হয় না বটে, তবে এর কদর ঘরে ঘরে। শীতল পাটির কাহিনি অনেক দীর্ঘ। ব্রিটিশ আমল থেকেই এর কদর। ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদে শীতল পাটি শোভা পেয়েছে। কিন্তু যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার মতো এমন একটি পণ্য আজ অবহেলিত। এর সাথে জড়িত কারিগররাও ধুঁকে ধুঁকে শেষ হচ্ছে। তবে ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ (আইসিএইচ) কমিটি শীতল পাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া শীতল পাটি নিয়ে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে হৈ-চৈ পড়ে যায়। ফলে এর সাথে জড়িত পেশাজীবীদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শীতল পাটির বুনন ও এটি তৈরির প্রধান উপকরণ মুর্তার ব্যাপক চাষ করলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি আসবে ভিন্নমাত্রায়। শীতল পাটির কারিগর হিসেবেও অনেক বেকার পুরুষ-মহিলার কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ভাটির জনপদে বর্ষার সময় কর্মহীন সময়কে কাজে লাগাতে পারে মুর্তা দিয়ে পাটি তৈরি করে। নানা ডিজাইনের শীতল পাটির কদর রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে।

বৃহত্তর সিলেটের বালাগঞ্জ শীতল পাটির জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের রাজনগর এলাকার ১০০ গ্রামের প্রায় ৪ হাজার পরিবার সরাসরি এ কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত। ভাটির জনপদ বলে খ্যাত জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর, ধর্মাপাশায়ও শীতল পাটি তৈরি হয়। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের রামেশ্বরপুর গ্রামের শীতল পাটির কথা অনেকেরই জানা। ওইসব অঞ্চলে প্রচুর মুর্তা উত্পাদন হয়। অনেকাটা আগাছার মতো পতিত জমিতে মুর্তার জন্ম। সিলেটের শীতল পাটির বুননশিল্পীরা ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’ নামে পরিচিত।

শীতল পাটি তৈরির ইতিহাস অনেক পুরনো। ব্রিটিশ আমলে শীতল পাটির খুব কদর ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শীতল পাটি শিল্প বাজারে মার খেতে শুরু করে। ব্রিটিশ আমল থেকেই বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া, চাঁনপুর, আতাসন, শ্রীনাথপুর, গৌরীপুর, মহিষাসি, লোহামোড়া, প্রভৃতি গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক লোক শীতল পাটি শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা বালাগঞ্জে জাহাজ ভেড়াত। সেখানে বিভিন্ন পণ্য বিক্রয় শেষে তারা নিয়ে যেত বাহারি শীতল পাটি। ভারতবর্ষে আগমনের প্রমাণ হিসেবে ভিনদেশিরা ঢাকার মসলিনের পাশাপাশি বালাগঞ্জের শীতল পাটি নিয়ে যেত স্মৃতি হিসেবে। ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের মতো শীতল পাটিও একসময় ছিল সৌন্দর্য ও শিল্পের প্রতীক। শীতল পাটি হরেক রকমের হয়ে থাকে। এর মধ্যে পয়সা, শাপলা, সোনামুড়ি, জয় পাটি, টিক্কা, সিকি, লাল গালিচা, আধুলি, মিহি প্রভৃতি পাটির কদর ছিল বেশি। কথিত আছে, মিহি পাটি এমনভাবে মিহি ও পিচ্ছিল করে তৈরি করা হতো যে একটা পিঁপড়া পর্যন্ত এর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারত না। শীতল পাটি শিল্পের সাথে জড়িতরা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। আর তাই পাটিতে তারা নানা ধরনের মন্দির, ত্রিশূল ও আলপনার আদল তৈরি করত। রানি ভিক্টোরিয়ার প্রাসাদে বালাগঞ্জের শীতল পাটি সংরক্ষিত ছিল। বাড়িতে নতুন জামাই কিংবা পরম কাঙ্ক্ষিত অতিথি এলে শীতল পাটি বিছিয়ে বসতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।

বাপ-দাদার পেশা বলে এখনো এ পেশার সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন পাটি শিল্পীরা। কিন্তু ছেলেমেয়েদের এ পেশার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেননি তাঁরা। সরকার যদি বাণিজ্যিকভাবে মুর্তা বেত চাষ করে এবং কারিগর তৈরি করে প্রশিক্ষণ দেয়, তাহলে সিলেটে বেশ কয়েকটি পাটি করখানা গড়ে উঠতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে এটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া ঠিক ওইভাবে মুর্তা বেতের চাষ না হলে এ শিল্পটি কাঁচামালের অভাবে হারিয়ে যাবে। এখন গ্রামাঞ্চলে মুর্তা পাওয়া যায় না। দূর থেকে মুর্তা কিনে এনে পাটি তৈরি করলে লাভ কম হয়। এতে উত্সাহ হারায় পাটি শিল্পীরা। একটা পাটি তৈরিতে কমপক্ষে মাসখানেক সময় লেগে যায়। কিন্তু বাজারে তা বিক্রি করলে ৩০০-৩৫০ টাকার বেশি দাম পাওয়া যায় না। ফলে শ্রমমূল্য না পাওয়ায় অনেকেই এখন আর শীতল পাটি তৈরিতে আগ্রহী নন। এজন্য দিনদিন মানুষের ঘর থেকে সরে গিয়ে শীতল পাটি শোভা পাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। শীতল পাটির প্রধান উপকরণ মুর্তা। কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনে মুর্তা উজাড় করে ফেলার কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে ক্রমেই মুর্তা হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় খাল-বিল ও লোকালয়ের পাশে প্রচুর মুর্তা পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে মুর্তা  দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। আশির দশকে সরকার মুর্তা উত্পাদনের জন্য কৃষকদের ঋণ দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তী সময়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এতে করে পাটি শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। সংস্লিষ্টরা জানালেন, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান ও সঠিক বাজারমূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে এ শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব ।

বনের মুর্তা দিয়ে তৈরি এই শীতল পাটি এখন বিশ্বদরবারে পরিচিত নাম। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই শীতল পাটি নিয়ে এখন সিলেটের মানুষের গর্বের অন্ত নেই। সিলেটের মানুষের কাছে শীতল পাটির কদর বেশি। এটি শুধু সিলেটেই নয়, ব্রিটেনে বসবাসরত সিলেটিদের কাছেও এই পাটি সমানভাবে আদ্রিত। ব্যক্তি উদ্যোগে সিলেট থেকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয় শীতল পাটি। শীত নামলেই সকালের নরম রোদে শীতল পাটি তৈরির ধুম পড়ে সিলেটের ঘরে ঘরে। গ্রাম এলাকার গৃহিণীদের কাছে শীতল পাটি তৈরি করা শখের কাজ। মা, চাচি, খালা, বোনেরা দল বেঁধে বসে এই শীতল পাটি তৈরি করেন। পাটি বিছিয়ে শীতের সকালে রোদ পোহানোর দৃশ্যও চোখে পড়ে গ্রামের পথে হাঁটলেই। সিলেটের গ্রামীণ জনপদের প্রায় মহিলা শীতল পাটি বুনতে জানেন। এখন শীতল পাটি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে। বালাগঞ্জ এলাকায় এসব পাটি তৈরি করে বাজারে বিক্রির জন্য তোলা হয়।

Back to top button