দেশের সংবাদ

মাতারবাড়ী টার্মিনালে এলএনজি নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে আগামীকাল

Image result for মাতারবাড়ী টার্মিনালে এলএনজি

দেশে দীর্ঘদিনে গ্যাসের সঙ্কট অবশেষে কেটে যাচ্ছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) নিয়ে জাহাজ আসছে আগামীকাল বুধবার। কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনালে ভিড়বে কাতার থেকে এলএনজির আমদানি চালানবাহী বিশেষায়িত জাহাজ। যা দেশে এবারই প্রথম। আর এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ এলএনজি যুগে প্রবেশ করছে। মাতারবাড়ী টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হবে। সেখান থেকে চট্টগ্রামে এসে যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে। এরজন্য ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন বসানো হয়েছে। গত সপ্তাহে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থার কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট কিছু অংশে পাইপলাইন বসানোর কাজ বর্তমানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাদবাকি কিছু কাজ সম্পন্ন হলে আগামী মে মাসের ১২ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যেই মাতারবাড়ীর এলএনজি গ্যাসের জোগান যাবে জাতীয় গ্রিড। এলএনজি গ্যাস আমদানি করে সরবরাহের ফলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরাজমান মন্দা কেটে বিনিয়োগ-শিল্পায়ন হবে গতিশীল। কেননা বিনিয়োগের জন্য চট্টগ্রামকে বিদেশী উদ্যোক্তারা একবাক্যে ‘আদর্শ স্থান’ হিসেবে স্বীকার করলেও গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে অনেক সম্ভাবনা আটকে আছে। এবার এলএনজি আমদানির ফলে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাত ছাড়াও গৃহস্থালীতেও গ্যাসের সঙ্কট নিরসনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই, আনোয়ারায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে নির্মাণাধীন বৃহৎ দু’টি অর্থনৈতিক জোন এবং ইতোমধ্যে আনোয়ারায় প্রতিষ্ঠিত কোরিয়ান ইপিজেডে (কেইপিজেড) শিল্প-কারখানাসমূহের চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের জোগান দেয়া হবে এলএনজির উৎস থেকে। তাছাড়া চট্টগ্রামের পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে এলএনজি গ্যাস সরবরাহ করা হবে সারাদেশে।

দেশে গ্যাসের মজুদ ও প্রাপ্তি অপ্রতুল, জটিল ও তা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে এলএনজি আমদানি ও সরবরাহের পুরো প্রক্রিয়া দ্রæততম সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশে গ্যাসের সঙ্কট বা ঘাটতি নিরসনের আশ্বাস প্রদান করেন। মাতারবাড়ী এলএনজি টার্মিনালসহ জ্বালানি হাব গড়ে তোলা এবং দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সঞ্চালন করে জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত করার পুরো প্রক্রিয়া দ্রæতায়িত করার ক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি এবং সুষ্ঠু সমন্বয় করে আসছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এম নসরুল হামিদ এবং সংশ্লিষ্ট সচিবগণ, পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বাহী বিশেষায়িত জাহাজ আগামীকাল (বুধবার) মাতারবাড়ী টার্মিনালে ভিড়বে। প্রতিটি জাহাজে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হয়। সেখান থেকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হবে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ। যা দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ঘনফুট। এরজন্য কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মিত হয়েছে। এই পাইপলাইন ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের। আবার আনোয়ারা থেকে সীতাকুÐ পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন বসানোর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মাতারবাড়ী থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু হলে দেশে গ্যাসের সঙ্কটের তীব্রতা অনেকটা কমে আসবে। বর্তমানে দেশে দৈনিক ৩৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ২৬৫ থেকে ২৭৫ ঘনফুট, চট্টগ্রামে ৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে মাত্র ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। চাহিদা মেটাতে বিশেষত দেশে শিল্পায়ন-বিনিয়োগের লক্ষ্যে এলএনজি আমদানি ও জোগান ভবিষ্যতে বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে সরকার। অবশ্য দেশের গ্যাসক্ষেত্রের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজির মূল্য বেশি হওয়ার কারণে গ্যাসের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।

এলএনজি আমদানি ও সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মহেশখালীতে জ্বালানি হাবের আওতায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে। আমেরিকান এক্সিলারেট এনার্জি সেখানে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। কাতারের রাস-গ্যাস কোম্পানির সাথে পেট্রোবাংলার চুক্তি অনুসারে বার্ষিক ২৫ লাখ মেট্রিক টন এলএনজি কাতার থেকে আমদানি করা হবে। তাছাড়া ওমান থেকে এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের সাথে অপর একটি চুক্তি আগামী মে মাসে সম্পাদিত হতে পারে। ওমান থেকে আমদানি হবে বছরে ১৮ থেকে পর্যায়ক্রমে ২৫ লাখ টন। তাছাড়া মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাথেও এলএনজি আমদানির বিষয়ে জিটুজি চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এলএনজি আমদানি ধাপে ধাপে বৃদ্ধির সাথে সাথে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২ হাজার ৫শ’ শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সংযোগ দেয়া হবে চলতি বছরের মধ্যেই।

বঙ্গোপসাগরের ধার ঘেঁষে মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনাল, বিদ্যুৎপ্রকল্প সহ একটি এনার্জি হাব এবং বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। আগামী ৫ বছরে এলাকাটি ‘মিনি সিঙ্গাপুরে’ পরিণত হওয়া শুরু হবে এমনটি আশাবাদ তৈরি হয়েছে। মাতারবাড়ী মেগাপ্রকল্পের মূল অবকাঠামো বিনির্মাণে সহায়তা করছে জাপান। ‘বিগ-বি’ এবং ‘বাংলাদেশ-জাপান ক¤িপ্রহেনসিভ পার্টনারশিপ’ সমঝোতার আওতায় জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) সেখানে অবকাঠামো তৈরির বিষয়ে নিবিড় গবেষণা, সমীক্ষা ও মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। যৌথ অথবা একক বিনিয়োগের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন খাত-উপখাতে অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় আগ্রহী জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ। মাতারবাড়ীর গুচ্ছ প্রকল্প ও মেগাপ্রকল্প সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক তথা অগ্রাধিকার বিবেচিত। জ্বালানি কেন্দ্র তথা এনার্জি হাব বিনির্মাণে জাইকার সহায়তায় মেগাপ্রকল্প-গুচ্ছ বাস্তবায়ন সহ এই মহাপরিকল্পনায় প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। মেগাপ্রকল্প-সমূহের মধ্যে রয়েছে এলএনজি ও জ্বালানি তেল টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক সর্বাধুনিক প্রযুক্তির তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন গভীর সমুদ্রবন্দর। জ্বালানি সুবিধা কাজে লাগিয়ে সেখানে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক, পর্যটন জোনসহ উপশহর গড়ে তোলা হবে।

Back to top button