দেশের সংবাদ

বাংলাদেশের চাকরীতে বিদেশী প্রভাব বাড়ার কি কারন ?

Image result for চাকরি

রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে পরীক্ষা দিতে থাকেন নাজমুন নাহার। শুরুতে সরকারি চাকরির চেষ্টা করে অবশেষে সেখানে ব্যর্থ হয়ে এরপর আবেদন করতে থাকেন বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার একটি পছন্দসই চাকরি আর পাওয়া হয়নি।

ঢাকার আরেকটি নামকরা কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে টেলিকম কোম্পানিতে দীর্ঘদিন কাজ করেন আব্দুল বাকি। পরবর্তীতে পদোন্নতি এবং চাকরির প্রতিযোগিতার কারণে তিনি সিএ এবং এমবিএ সম্পন্ন করেন। কিন্তু মধ্যম সারির চাকরিগুলোতে আবেদন করে খুব একটা সাড়া মিলছে না।

প্রেক্ষাপট যখন এমন তখন দেশের ব্যবসায়ী নেতা এবং গবেষকরা বলছেন, দক্ষ জনশক্তি না পাওয়ায় বিদেশি কর্মীদের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতি বছর কয়েকশো কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। শুধুমাত্র ভারতেই যাচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার।

এ প্রসঙ্গে মি: বাকি বলছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা- “আমি আসলে একমত হতে পারছি না। আমাদের দেশের যারা ভালো দক্ষ আছে তারাও কাজ করছে। জয়েন্ট কোলাবরেশনে তারা হয়তো কাজ করছে। তবে মধ্যম সারির কিংবা একেবারে টপ পজিশনগুলোতে নিয়োগে জোরালো রেফারেন্স লাগে।”

তবে মো: আজিজুর রহমান বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল বিষয়ে সদ্য পাশ করেছেন।

দক্ষ জনশক্তির কিছুটা অভাব আছে এটা ঠিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা যারা পড়ছি আমাদের টেকনিক্যাল স্কিলগুলো বাইরের লোকজন থেকে কম। এখন বিশ্বে টেকনোলজিতে নতুন নতুন ট্রেন্ড আসছে। আর আমরা এখনো পড়ে আছি ৮০, ৯০-র দশকে। পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে সিলেবাস থেকে ট্রেনিং সবকিছু। একাডেমিক লেভেলে এবং সিলেবাস মডারেট করা দরকার।”

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স এসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্যবসায়ী নেতা ফজলুল হক বিবিসিকে বলেছেন, “দেশে মিড লেভেল ও টপ লেভেলের প্রফেশনালদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে আসা কর্মীরা চাহিদা মেটাতে পারছে না।”

নিজের ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে মি: রহমান বলেন, “আমি নিজেইতো টেক্সটাইলে গার্মেন্টসে ইন্টার্ন করতে গিয়ে লক্ষ করেছি যারা ম্যানেজমেন্ট লেভেলে তারা শ্রীলংকার এবং ভারতীয়।

এছাড়া অনেকে কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও, তাদের মধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, মূলত কারিগরী শিক্ষার অভাব এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাবে তারা দেশীয় কর্মীদের বদলে বিদেশীদের ওপর নির্ভর করছেন। আর এভাবে বাংলাদেশ কোটি কোটি ডলার হারাচ্ছে।

সদ্য পাশ করা মো: আজিজুর রহমান বলেন, “আমি যখন ইন্টার্ন করি আমার অধীনে কিছু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কাজ করেছেন, তারা ভাল করে মেইল লিখতে পারতেন না। তো এসব ক্ষেত্রে আসলে কিছু সমস্যা আছে।”

বাংলাদেশের বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, গার্মেন্টস, ওষুধ কোম্পানি কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কাজ করছেন অনেক বিদেশি নাগরিক। এসব কর্মীদের মধ্যে শীর্ষে আছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা। এর পরে পাকিস্তান, ফিলিপিন, কোরিয়া ও চীন থেকে আসা কর্মীরা।

প্রবাসী বাংলাদেশীদের অর্থে দেশ সচল করার কথা বলা হচ্ছে একদিকে কিন্তু অন্যদিকে বিদেশি কর্মীদের হাত দিয়ে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে বহু কোটি ডলার।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি বলছে, তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানাতে বিদেশী কর্মীরা কর্মরত আছেন। দু’বছর আগে সিপিডির আরেক গবেষণার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে যে রেমিটেন্স যায় তার মধ্যে শুধুমাত্র ভারতেই যায় ৫০০ কোটি ডলারের মতো, জানান সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন।

মি: হোসেন জানান, দক্ষতার ঘাটতির কারণেই বিদেশি কর্মীদের হাতে চলে যাচ্ছে দেশের অর্থ।

তার মতে, “দেশের ভেতরে যারা গ্রাজুয়েট হচ্ছেন, তারাও উপযুক্ত মান সম্পন্ন নন। তাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে।”

কী বলছেন পাঠকেরা?

এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার সামাজিক পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে পাঠকদের মধ্যে। সেখানে মতামত দিয়েছেন বহু মানুষ।

নিজামউদ্দিন নামে একজন পাঠক লিখেছেন, “বাংলাদেশে মানসম্পন্ন শিক্ষায় ঘাটতি আছে। প্রচলিত শিক্ষায় অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু মানসম্পন্নভাবে নয়। তার জন্য দেশের সরকারই দায়ী। এখানে অনেক ছেলে-মেয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পরেও ভালো ইংরেজি জানে না। জানবে কীভাবে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা যে এমন। শুধু পরীক্ষার সময় ইংরেজি গ্রামার, পেরাগ্রায়, ডায়লগ,লেটার ইত্যাদি মুখস্থ করে পরীক্ষা দাও। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি না পরিবর্তন করে, সময় উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে -তাহলে এমন শিক্ষার প্রয়োজন নাই।”

আসিফুর রহমান লিখেছেন, “ঘাটতি কোন সমস্যাই নয় বরং সমস্যা হচ্ছে সরকারের মানসিকতার। দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকতেই পারে কিন্তু সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে খুব সহজে এবং অল্প সময়েই তা সমাধানযোগ্য। কিন্তু সরকার চায়, বাংলাদেশে ভারতের জন্য সুযোগ খুলে দিতে।”

আরিফুর রহমান নামে আরেকজনের মত, “বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে বিদেশীরা কাজ করতে পারে, আর দেশে যোগ্য লোক খুঁজে পায় না, বাংলাদেশের কয়টা কোম্পানির ট্রেনিং ও রিসার্চ সেন্টার আছে?”

শাহ শিহাব নামে আরেকজন পাঠক লেখেন, “সত্যি কথা বলতে কি! বাংলাদেশে অবশ্যই দক্ষ জনশক্তি আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে দক্ষের চেয়ে অদক্ষ জনশক্তি বেশী এবং দক্ষ জনশক্তি বাছাই প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। আর এজন্য দায়ী আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা। সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে প্রাকটিকালি কোনকিছুই শিখানো হয়না। …বর্তমানে সার্টিফিকেট দ্বারা কিছু বিচার করা কঠিন। ……. “

মাইদুল ইসলাম সাইমন লিখেছেন, “এটা আমাদের দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাকর ঘটনা। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি আসলেই সময়োপযোগী নয়। আমাদেরকে যা শিখানো হচ্ছে তা কেবলই সনদ অর্জনের জন্য কাজে লাগে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে তা খুব কমই কাজে লাগে। কী দরকার বেকার তৈরির কারখানা নামক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার। আমরা শুধু সার্টিফিকেটই অর্জন করছি আর শিক্ষিত নামধারী বেকার হচ্ছি মাত্র।”

অন্যদিকে দুলাল হোসেন নামে আরেকজন লেখেন, “সমস্যা শিল্পপতিদের। তারা মনে করে বিদেশীরা তাদের প্রতিষ্ঠানে খুব ভালো কাজ করে। অথচ দেশেই অনেক যোগ্যতম প্রার্থী রয়েছে যাদের নিকট থেকে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে বেশি সাপোর্ট পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা বিদেশ-প্রীতি কাজ করে সবসময়ই।”

“দক্ষতার অভাব নয়, অভাব মানসিকতার। ভাল লোকজন প্রাইভেট সেক্টরে আসতে চায় না।কারণ সামাজিক অবস্থা। বিয়ের বাজারে ১লক্ষ টাকা বেতন পাওয়া ছেলের চাইতে সরকারি একজন পিয়নের মূল্য বেশী। আর একটা বড় কারন মালিক পক্ষ,এরা দেশী লোকদের মূল্যায়ন করে না”- লিখেছেন আরিফুল ইসলাম।

আরিফ খান জয় মনে করেন, “গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে দক্ষ লোকের অভাব নেই তারপরও গার্মেন্টস সেক্টরে ইন্ডিয়ানদের প্রভাব খুব বেশি। এর প্রধান কারণ সরকারের ভারত প্রীতি। যেখানে একজন বাংলাদেশী লোক যদি চিকিৎসার জন্য ১ মাসের ভারতীয় ভিসার জন্য এপ্লাই করে তাকে দিবে ৭-১০ দিনের ভিসা। কিন্ত ভারতীয়রা যদি বাংলাদেশে চাকরির জন্য ভিসার আবেদন করে তাহলে তারা খুব দ্রুত ভিসা পেয়ে যায়…।”

Back to top button