ঢাকায় ফ্লাটের দাম হু হু করে বাড়ছে
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আবাসন সংকট একটি বহুল আলোচিত বিষয়। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মূহুর্তে ঢাকায় কুড়ি হাজার তৈরি ফ্ল্যাট অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে।
অন্যদিকে, ঢাকায় একটু মাথা গোঁজার ঠাই এর ব্যবস্থা করতে হিমসিম খাচ্ছেন মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
আবার একই সঙ্গে অনেক সময় প্রতারণা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে আবাসন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এমন প্রেক্ষাপটে কী করছে কর্তৃপক্ষ?
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। গত প্রায় ছয় বছর যাবত তিনি ও তার স্বামী ঢাকায় মাথা গোঁজার একটি স্থায়ী ঠাঁই খুঁজছেন। কিন্তু তাদের সামর্থ্যের মধ্যে একটি বাসা বা ফ্ল্যাট আজো তারা মেলাতে পারেননি।
“রোজগারের বড় অংশটি চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়, তখন খুব মন খারাপ হয়। মনে হয়, নিজের একটি বাড়ি থাকলে এটা হতো না। কিন্তু ফ্ল্যাটের যে দাম, তা সেভিংস জমিয়ে কুলাতে পারি না। আবার যাদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট নেব বা লোন যদি নিতে হয়, ঠিক ভরসা পাই না তাদের ওপর।”
“আবার একটা দাম টার্গেট করে ধরুন পয়সা জমাই, মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসে দেখি সেটার দামও তখন বেড়ে গেছে।”
নুসরাতের উন্নয়নকর্মী স্বামীও এখন আগ্রহ হারিয়ে বাড়ির খোঁজ খবর করা ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নুসরাত আশা ছাড়েননি। এখনো পত্রিকার পাতায় ও পথেঘাটে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপনে চোখ রেখে যাচ্ছেন।
এই পরিবারটির মত ঢাকায় বসবাসরত বহু মানুষেরই অভিযোগ বেশি দামের কারণে তারা নিজেদের জন্য একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে পারছেন না।
এই মানুষদের সংখ্যা আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়্যাল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী ঢাকার মোট বাসিন্দার মধ্যে যারা নিজে একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হতে চান তাদের অন্তত অর্ধেক।
আর মধ্য আয়ের এই লোকজনের মধ্যে ৬০০–১২০০ বর্গফুট মাপের ফ্ল্যাটের চাহিদা বেশি বলে জানাচ্ছেন ঢাকার আবাসন ব্যবসায়ীরা
ঢাকার একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ আবীর বলছিলেন, একজন ক্রেতা সাধারণত কোন্ আকৃতির ফ্ল্যাটে ঠিক কি কি জিনিস পেয়ে থাকেন
“৬০০—৮০০ বর্গফুটের মধ্যে থাকে দুটি শোবার ঘর, দুটি বাথরুম আর ভাবার ঘর ও বসার ঘর। আর ৯০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটে থাকে তিনটি শোবার ঘর, অন্তত দুটি বাথরুম, লাগোয়া বারান্দা। এর উপরে দুই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে চারটি শোবার ঘর বানানো যায়।”
ফ্ল্যাটের দাম একেক এলাকায় একেক রকম। ঢাকার শ্যামলীতে একটি ফ্ল্যাট কিনতে গেলে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়বে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
এখান কয়েক কিলোমিটার উত্তরে মিরপুরেও প্রতি বর্গফুটের দাম একই রকম। কিন্তু আবার শ্যামলী থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে ধানমন্ডিতে প্রতি বর্গফুটের দাম হবে আট হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
গুলশান কিংবা বারিধারায় সেটি হবে আরো বেশি।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বলছেন, সেই দাম ক্রমে বেড়েই চলেছে। রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী গত তিন দশকে ঢাকায় জমির দাম গড়ে ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে নুসরাতের মত অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও যেকোনো এলাকায় ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবতেও পারেন না।
কিন্তু জমির দাম এত বৃদ্ধি পাবার কি কারণ? জিজ্ঞেস করেছিলাম নগরবিদ এবং বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলামের কাছে,
“ঢাকার জনসংখ্যা যেমন গত ত্রিশ বছরে যত বেড়েছে, জমি তো সেভাবে বাড়েনি। ফলে চাহিদা এবং যোগানের ব্যবধানের কারণে জমির দাম বেড়েছে। এছাড়া জমিটি একজন দরিদ্র মানুষ যে দামে বিক্রি করেন, সেটা দুই তিন হাত ঘুরে ডেভেলপারের হাতে এসে দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়।”
অধ্যাপক ইসলাম আরো বলছেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার কারণেও অনেক সময় জমির দাম বেড়ে যায়।
কিন্তু কেবল থাকার জায়গার দাম নয়, বাণিজ্যিক ব্যবহারের জমি অর্থাৎ মতিঝিল বা মহাখালী যে জায়গাগুলো মূলত অফিস হিসেবে বেশি পরিচিত, সেসব জায়গারও দাম বেড়েছে।
এদিকে, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী এই মূহুর্তে শুধু মাত্র ঢাকায় বিভিন্ন মাপের এবং দামের কুড়ি হাজারের বেশি ফ্ল্যাট অবিক্রীত অবস্থায় আছে। কিন্তু ক্রেতার আগ্রহ থাকার পরেও কেন অবিক্রীত থাকছে ফ্ল্যাট?
এ প্রশ্নের জবাবে রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন অবশ্য জমির দাম বৃদ্ধির পেছনে আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি
“আমরা কম পয়সায় জমি না পেলে ফ্ল্যাটের দাম কম কিভাবে রাখব? তবে সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে মধ্য বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জমি বরাদ্দ করে দেয়, তাহলে সেখানে কম পয়সার মধ্যে ফ্ল্যাট বানানো সম্ভব। যেমন কালসীতে সরকারের অনেক খাস জমি আছে, সেগুলো বরাদ্দ দিতে পারে।”
আলামিনের হিসাবে ঢাকায় বছরে গড়ে আট হাজার নতুন ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। তবে, ২০১৭ সালে রিহ্যাবের সদস্য আবাসন ব্যবসায়ীরা প্রায় এগারো হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন।
ব্যাংক এবং কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান হোম লোন দেয়, কিন্তু তার উচ্চ সুদের হার নিয়েও রয়েছে অসন্তুষ্টি।
এতো গেল যারা সাধ আর সাধ্যের মধ্যে মিল ঘটতে পারছেন না তাদের গল্প। এর সঙ্গে আছে ভিন্ন ধরণের গল্পও। ঢাকার গ্রীনরোডে ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে কেমন ঝামেলায় পড়েছিলেন শিখা রহমান চলুন শুনি সেই গল্প
“নির্মাণাধীন দুইটি ফ্ল্যাটের পুরো মূল্য পরিশোধ করার পর আমি হঠাৎ দেখি কাজ বন্ধ। ডেভেলপার কিছু আর বলে না, কাজও করে না। ডেভেলপারের কাছে গেলাম, কিছু বলেনা। জমির মালিকের কাছে গেলাম, জানলাম তিনিও আমাদের মত বিপদে।”
“এরপর হঠাৎ জানতে পারলাম, আমার একটি ফ্ল্যাট ডেভেলপার অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। শুনে একেবারে অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে এসে উঠি ফ্ল্যাটে, দরজা নাই, জানালা নাই, পানি নাই—এমন অবস্থায় এসে উঠেছিলাম সেই বাসায়।”
মিজ রহমান জানিয়েছেন এরমধ্যে বেশ কটি মামলা করতে হয়েছে তাদের। মাস্তান দিয়ে ভয় দেখিয়ে ডেভেলপার তাদের তাড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করেছিল। অনেক কষ্টের পর ফ্ল্যাট কিনেছেন যারা তারা সবাই মিলে বাড়ির কাজ শেষ করেন। এরকম অনেক আবাসন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই প্রতিশ্রুত সময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর না করা এবং প্রতারণার অভিযোগ শোনা যায়।
কিন্তু সেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা কমই আছে। রিহ্যাব এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক উভয়ই বিষয়টি স্বীকার করলেন। কিন্তু আইনি ব্যবস্থা ছাড়া এর বিরুদ্ধে অন্য ব্যবস্থা কমই নেয়া যায়।
ঢাকার গুলিস্তানে রাজউক এভিনিউতে রাজউক কার্যালয়ে কথা হলো সংস্থাটির চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, অনেক অভিযোগ তারা পান, সে অনুযায়ী মধ্যস্থতার চেষ্টা তারা করেন, কিন্তু সরাসরি কোন ব্যবস্থা তারা নিতে পারেন না
“এ ধরণের অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। আমি অনেক ডেভেলপারকে ডেকে নিরসনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কারণ যদিও আমরা তাদের নিবন্ধন দিয়ে থাকি, কিন্তু অনেক ডেভেলপার আমাদের নিবন্ধিত আবার অনেকেই তো নিবন্ধিত নন। ফলে ব্যবস্থা নেয়া হয়না।”
“এখন আমরা আইনের মাধ্যমে একটা ছাতার নিচে সবাইকে নিয়ে আসতে চাই যাতে অনিয়মগুলো দূর করা যায়।”
রিহ্যাব সভাপতি মিঃ আলামিনও জানিয়েছেন, প্রতারণার শিকার ক্রেতা অভিযোগ জানালে মধ্যস্থতার মাধ্যমে তারা তা সমাধান করার চেষ্টা করেন। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে ছয়শোর বেশি অভিযোগ সুরাহা করেছে রিহ্যাব। এর বাইরে মামলাও হয় প্রচুর। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে যত মামলা হয় তার ৬০ শতাংশই হয় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রায় সাড়ে আটশো বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে দুই কোটির মত মানুষের আবাসের ব্যবস্থা করা একটি দুঃসাধ্য কাজ। যেখানে নগরবিদ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ইসলাম মনে করেন সরকারকে নতুন করে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে তার পরামর্শ হলো, জমি বা ফ্ল্যাটের মালিকানার বদলে দীর্ঘ মেয়াদে রেন্টাল ভিত্তিতে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।
কিন্তু তার আগে এই মূহুর্তে আবাসন খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধান করতে হবে, নইলে একজন ক্রেতা তার সব নাগরিক সুবিধা পাবেন না। যেমন এখন নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে গেলে গ্যাস ও পানির সংযোগের জন্য আলাদা অর্থ দিতে হয় ক্রেতাদের। কারণ সরকার একটা সময় পর্যন্ত নতুন প্রকল্পে এসব সংযোগ বন্ধ রেখেছিল। নতুন অনুমতি শুরু হবার পর, পুরনো আবেদন আগে বিবেচনায় আসছে। ফলে ক্রেতা এবং আবাসন ব্যবসায়ী সবাই বলছেন সরকারকে দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে।