জাতীয়শিক্ষা

‘ইসলাম শিক্ষা’ বইয়ে কুরআন শরীফ বিকৃতি !

0d
ঢাকা : এতদিন ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আরবিতে লেখা কুরআন-হাদিসের অংশবিশেষ পুনঃপাঠ বা বানান পরীক্ষণের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) অভিজ্ঞ কোনো লোকবল ছিল না। রচয়িতা, সম্পাদক, জাতীয় কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটর কমিটি (এনসিসিসি), ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত, অভিভাবকদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুনঃসংযোজন বা বিয়োজন করা হতো।’

ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আরবি বানানে ৪ বছর ধরে চলতে থাকা ৫৮টি ভুলের বিষয়ে জানতে চাইলে এভাবেই বাংলামেইলের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশকুমার সরকার।

বই রচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের সে বিষয়ের পাঠ্যবই রচনা এবং সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়। লেখক যখন একটি বই সম্পন্ন করেন, তখন সেটি সম্পাদকের সম্পাদনা শেষে এনসিসিসি কমিটিতে পাঠানো হয়। এনসিসিসিতে শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গড়া ২২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে।’

‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটির রচয়িতা হলেন : মুহাম্মদ আবদুল মালেক, ড. মুহাম্মদ আবদুর রশীদ, ড. মোহাম্মদ ইউছুফ, মুহাম্মদ ইউসুফ আলী শেখ, ইকবাল মো. জাহাঙ্গীর আলম শরীফ। সম্পাদনা করছেন, ডক্টর মো. আখতারুজ্জামান ও মুহাম্মদ তমীযুদ্দীন।

এনসিসিসির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রীতিশকুমার বলেন, ‘জাতীয় কারিকুলাম কো-অর্ডিনেটর কমিটি বইটিকে ধর্ম-রাষ্ট্র-ব্যক্তি-পক্ষপাতদুষ্ট কোনো কিছু আছে কি না তা নির্ণয় করে। অসংলগ্ন কিছু পেলে সেটিকে অধিকতর নিরীক্ষার জন্য স্পেশাল কমিটি গঠন করে। স্পেশাল কমিটির রিপোর্ট, লেখক, সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে এনসিসিসি বিষয়টি বিয়োজন বা সংযোজন করে থাকে। তারপর বইটির বিষয়বস্তুগুলো এনসিটিবিতে পাঠানো হয়।’

‘এনসিটিবির পরবর্তী কাজ হলো, অধ্যায় সাজানো, প্রুফ দেখানো, বই ছাপানোর পর আবার প্রুফ দেখানো, বই বিতরণের পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতামত, অভিভাবকের মূল্যায়ন গ্রহণ করা। পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলে এনসিটিবি ওিই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ৪/৫ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক ডেকে ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সংশোধন করা,’ বলছিলেন প্রধান সম্পাদক।

এতগুলো সুদক্ষ হাত ঘুরে যে বইটি তৈরি হয় সে বইটিতে এত ভুল, যারা বইটি পড়াচ্ছেন তারাও ধরতে পারেননি, এ বিষয়ে আপনাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভুলের জন্য আমরা লজ্জিত। যারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয় তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তবে দুঃখের বিষয় কোনো শিক্ষক আজ অবধি এ বইটিতে ভুল আছে এরকম কোনো অভিযোগ বা তথ্য আমাদেরকে দেননি।

শিক্ষক এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটার উত্তর দেয়া দুষ্কর।’

চার বছর ধরে বইটি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে, এনসিটিবি প্রতি বছর বইটির পরিমার্জন বা পুনর্মুদ্রণ করছে। পরিমার্জনের ফলাফল কী হলো? প্রীতিশকুমার বলেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যক ব্যক্তিকে সম্মানি দিয়ে রাখা হয়।’

জানা যায়, এ বইটির দায়িত্বে ছিলেন এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) প্রফেসর মশিউজ্জামান। আরবি বানান তদারকির জন্য ৬ মাস আগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে উম্মে কুলসুম নামে একজনকে।

গুরুত্বহীনতার কারণে এরকমটা ঘটছে কি না? এ প্রশ্ন করা হলে মশিউজ্জামান বলেন, ‘বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ লোকবল দিয়ে বই প্রণয়ন, সম্পাদন, সুপারভিশন করা হয়। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।’

তাহলে ভুলের দায় কে নেবে? তিনি বলেন, ‘আমরা তো দায় এড়াতে চাচ্ছি না। আর আপনি যে ভুলের কথা বলছেন আমি তো জানি না এগুলো কতটা ভুল। অভিযোগ পেয়েছি, এখন যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদেরকে দিয়ে এ বিষয়ে কয়টা ভুল আছে তা নিশ্চিত করতে হবে।’

যে প্রক্রিয়ার কথা আপনি বলছেন সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গত চার বছর বইটি প্রক্রিয়াজাত হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। বইটি পরিমার্জিত, পুনর্মুদ্রণ সংস্করণ সবমিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের হাত ঘুরে বেরিয়েছে। ভুল তো সংশোধন হয়নি। এখন কীভাবে হবে? উত্তরে মশিউজ্জামান বলেন, ‘আর কী প্রক্রিয়া আছে বলেন। বই প্রণয়নের এটাই আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়।
তাহলে ভুল কেন? এর উত্তর তিনি দিতে পারেননি।

উম্মে কুলসুমকের কাছে একই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণির বইটি দেখি। এ বইটি রেবেকা সুলতানা লিপি দেখেন।’

সেসময় রেবেকা সুলতানা লিপিকে পাওয়া যায়নি। লিপি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইটিতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম থেকে শুরু করে যে কয়টি আরবি সুরা, হাদিস, দোয়া আছে প্রায় সবকটিতে আরবি বানানে ভুল। অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে বাংলামেইলকে সহযোগিতা করেছেন মিরপুর ৬ নম্বরে অবস্থিত মাদরাসায়ে দারুল উলুমের মুহাদ্দিস, হাফেজ মাওলানা মুফতি মাসুম বিল্লাহ।

ভুলগুলো সম্পর্কে তার মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় কিতাবগুলোকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেয়া হয় না। গুরুত্ব না দেয়ার কারণে এসব দায়িত্বহীনতা। অথবা অযোগ্য লোক দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। আর যারা বইটি ক্লাসে পড়াচ্ছেন তাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ।’

এনসিটিবির নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমি তো নতুন এসেছি, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি। আপনি যদি একবার কারেকশন কপিটি দিয়ে যান, পরবর্তীতে ছাপার সময় আমরা সঠিকভাবে ছাপাতে পারব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button