নিজস্ব প্রতিবেদক :চকবাজার থেকে বনানী। বনানী থেকে গুলশান। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে সব সেবা সংস্থাই। এতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার পর অভিজাত এলাকা বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। আত্মরক্ষার্থে বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মানুষের করুণ মৃত্যু শিহরিত করেছে সবাইকে। বনানীর পর গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের আগুনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যায়। অল্পদিনের ব্যবধানে এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কিত রাজধানীবাসী।
রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। একইসঙ্গে যেসব বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ সুবিধা বা সরঞ্জাম নেই সেগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে। গত সোমবার এ অভিযান শুরু হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ভবন মালিকরা। কারণ রাজধানীর অধিকাংশ ভবন বিল্ডিং কোড, নিয়ম, নকশা না মেনে নির্মাণ করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের জরিপ মতে, রাজধানীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, কম ঝুঁকিপূর্ণ- এ তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে ভবন মালিকদের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেয়ার জোর তাগিদও দেয়া হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। তবে সে তাগিদ বরাবরই উপেক্ষা করে আসছে ভবন মালিকরা।
এবার রাজধানীর বিভিন্ন উচ্চ ভবনের সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখতে অভিযানে নেমেছে রাজউক। রাজউকের ৮টি জোনের অধীনে ২৪টি টিম (অথোরাইজড অফিসার, সহকারী অথোরাইজড অফিসার, প্রধান ইমারত পরিদর্শক, ইমারত পরিদর্শকের সমন্বয়ে) ১০ তলার বেশি বহুতল ভবনগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
জোনগুলো হচ্ছে- জোন-১ (আশুলিয়া, ধামসোনা), জোন-২ (উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর), জোন-৩ (সাভার, মিরপুর), জোন-৪ (গুলশান, বনানী, মহাখালী, পূর্বাচল), জোন-৫ (ধানমন্ডি, লালবাগ), জোন-৬ (মতিঝিল, ভুলতা), জোন-৭ (কেরানীগঞ্জ, জুরাইন, সূত্রাপুর, ওয়ারী) এবং জোন-৮ (ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও )। রাজউকের এ অভিযান আগামী ১৫ দিন চলবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রাজউকের এ অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ভবন মালিকেরা। তারা মনে করছেন, যেহেতু সব ধরনের নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করেননি সেহেতু রাজউকের অভিযানে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমনকি তাদের ভবনের অংশবিশেষও অপসারণ করা লাগতে পারে। পাশাপাশি ভবনে নানা সুবিধা বাস্তবায়ন করতে আর্থিক ব্যয় বাড়ারও আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
গত ২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে এফআর টাওয়ারে আগ্নিকাণ্ডের পর জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৮ তলা ভবন নির্মাণের জন্য এফআর টাওয়ারের নকশা রাজউক থেকে অনুমোদন করা হয়। এরপর সেখানে নির্মাণ করা হয় ২৩ তলা। রাউজকের অনুমোদিত নকশা থেকে এ ভবনের নকশায় আরও অনেক বিচ্যুতি ঘটেছে। এফআর টাওয়ারের মালিকপক্ষ ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজউকের কাছে আরেকটি নকশা পেশ করে, যার সঙ্গে রাজউকে সংরক্ষিত নকশার কোনো মিল নেই।
বনানীতে অবস্থিত একটি বাণিজ্যিক ভবনের মালিকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজধানীর বেশির ভাগ ভবন বিল্ডিং কোড মানে না। এর দায় রাজউকের, কারণ কিছু অসাধু কর্মকর্তা এসবের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন কূটকৌশলে ভবন মালিকরা নকশার সঙ্গে ভবনের মিল রাখেন না। এফআর টাওয়ারের মতো রাজধানীতে অনেক বহুতল ভবন রয়েছে নকশার সঙ্গে যেগুলোর মিল নেই, বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। বেশিরভাগ ভবনেই নেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। এরমধ্যে রাজউকের এমন অভিযানে ভবন মালিকরা আতিঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ রাজউক সঠিকভাবে অভিযান পরিচালনা করলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
রাজধানীর মতিঝিলের বহুতল একটি ভবনে সোহরাব হোসেন নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবীর অফিস। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা সাধারণ মানুষ এসব বহুতল ভবণে জীবিকার তাগিদে অফিস করি তারা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনার কথা ভেবে। তাই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে রাজউকের এমন অভিযানকে আমরা সাধুবাদ জনাই। আমরা চাই সব বহুতল ভবনসহ অন্যান্য ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। অভিযানের কারণে ভবন মালিকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে জীবনের নিরাপত্তা অনেক বেশি।’
এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমরা পেছনে যেতে চাই না। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার তাই করা হবে। আর কোনো ছাড় নয়। যারা আইন মানছেন না তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। আমরা অভিযান শুরু করেছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী যেসব বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে শুধু সেসব ভবনের বিরুদ্ধেই অভিযান চলবে। ভবনগুলোতে আগুন নেভানোর নিজস্ব ব্যবস্থা কেমন, মূল সিঁড়ির পাশাপাশি জরুরি বিকল্প সিঁড়ি আছে কি-না, পাম্পের কী অবস্থা, লিফট-ফায়ার লিফট, জেনারেটর কক্ষ ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আছে কি-না এসব বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত হন। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর বহুতল ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে।
এদিকে রাজধানীর সদরঘাট এলাকার ইস্টবেঙ্গল ইনস্টিটিউটশন সুপার মার্কেটসহ ৫৩ ভবনকে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া ১৭৩ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সদরঘাট ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) মোস্তফা মোহসিনের নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল ইনস্টিটিউটশন সুপার মার্কেটকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ সংবলিত ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়।
অন্যদিকে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছে, কোনো ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে সে বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য ‘অভিযোগ বক্স’ চালু করতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। পাশাপাশি ফোন ও হোয়াটস অ্যাপ নম্বরও থাকবে। এসব মাধ্যমে যারা অভিযোগ জানাবেন তাদের পরিচয় গোপন রাখা হবে। যারা ভবনের সমস্যা জানাবেন তাদের পরিচয়ও গোপন রাখা হবে। তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কাজ করে সবাইকে নিয়ে নিরাপদ ঢাকা গড়ে তুলব। প্রতিটি আঞ্চলিক অফিসে অভিযোগ বক্স খোলা হবে। একটি ফোন নম্বর চালু করব। সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপ সংযোগ থাকবে। আমরা একটি নগর অ্যাপ চালু করার জন্যও কাজ করছি।
এ দৌড়ঝাঁপে ভবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যাবে-এমন ভয়ে আছেন ভবন মালিকরা। একদিকে রাজউকের অভিযান অন্যদিকে ডিএনসিসির উদ্যোগে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা।
মতিঝিলে এলাকায় অধিকাংশ ভবনেই নেই পার্কিং সুবিধা
রাজধানীর মতিঝিল এলাকার বহুতল ভবনগুলোর বেশির ভাগেরই কার পার্কিং স্পেস নেই। মতিঝিল এলাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবন ৯০ দশকের শুরু থেকে পরবর্তী পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে। সে সময় এসব ভবনে পার্কিং স্পেস রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। তারপরও রাজউকের ছাড়পত্র নিয়েই নকশাবহির্ভূতভাবে পার্কিং ছাড়াই বহুতল ভবনগুলো নির্মিত হয়েছে।
জানা গেছে, মতিঝিলে বহুতলবিশিষ্ট ভবন রয়েছে ১৫৭টি। এর মধ্যে শুধু ১৭টিতে আছে পার্কিং স্পেস। বাকি ১৪০টি ভবনেই গাড়ি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই।
পার্কিং ব্যবস্থাহীন ভবন, মার্কেট, শপিং মল এখন যানজটসহ জনদুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিল্ডিং কোড অমান্য করে প্রকাশ্যে একের পর এক ভবন গড়ে উঠছে নগরজুড়ে। সুউচ্চ ভবনগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের পুরোটা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা। এখানে গুটিকয়েক ভবন রয়েছে ৫০-৬০-র দশকের দিকের ভবন।
বিভিন্ন সময় অফিস পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে রাজউক ভবন এসবের একটি। এ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ্যযোগ্য কোনো গাড়ি পার্কিংয়ের স্পেস নেই। পার্কিং একটি ছোট জায়গা থাকলেও সেখানে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের থাকার জায়গা বানানো হয়েছে। তবে রাজউকে প্রবেশ পথেই কিছু ওপেন স্পেস রয়েছে। সেখানে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাড়ি রাখা হয়।
রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রাকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজউক অভিযান পরিচালনা করে আর তাদেরই যদি পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকে তাহলে তা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয় না। যদিও রাজউক ভবন যখন নির্মাণ হয়েছে তখন পার্কিং ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক ছিল না। পরবর্তীতে রাজউকের ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা অনুসারে ছয়তলার উপরে নির্মিত সব ভবনের নকশা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।