মতামতসামাজিক গণমাধ্যম

দিল্লি নির্বাচনে ভোটের অঙ্ক: বিজেপির রাজনীতি কি সত্যিই প্রত্যাখ্যাত ?

 দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির পরাজয় সমগ্র উপমহাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (এএপি) ৭০ আসনের মধ্যে ৬২টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন।

নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন, দিল্লির নির্বাচনে হেরে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, বিজেপির আদর্শ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

দিল্লিতে এএপি-র হ্যাটট্রিক বিজয়ে উল্লাসে ভাসছেন বিজেপিবিরোধী শিবির। বিজেপির পরাজয়ের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, দেশে ঘৃণার রাজনীতির কোনো জায়গা নেই। বিজেপি শুরু থেকেই বিদ্বেষের রাজনীতি করে এসেছে। মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন।

কংগ্রেসের সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ধর্মান্ধদের পরাজয় হয়েছে।

ভারতীয় মিডিয়া ও ভারতের অধিকাংশ বিশ্লেষক প্রায় একই ভাষায় বলছেন, দিল্লির নির্বাচনে হিংসার বিপরীতে ইতিবাচকতার জয় হয়েছে।

নির্বাচনে দিল্লিবাসীর দেওয়া রায়ের তাৎপর্য নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে কিছু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিতে হবে।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সাধারণ নির্বাচনে দিল্লিতে আসন ৭টি, আর আঞ্চলিক বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লিতে আসন ৭০টি। গত তিনটি লোকসভা [কেন্দ্রীয় সরকার] নির্বাচন এবং বিধানসভা [আঞ্চলিক] নির্বাচনে দিল্লিবাসীর রায়ে দেখা যায় যে, ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস দিল্লিতে ৫৭.১১ শতাংশ ভোট পেয়ে লোকসভার ৭টি আসনেই বিজয়ী হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৫.২৩ শতাংশ পপুলার ভোট—যদিও তারা লোকসভায় একটি আসনও পায়নি। সেসময় আম আদমি পার্টি (এএপি) ছিল না।

২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৩.০৭ শতাংশ ভোট, আসন পেয়েছিল ৩১টি। এএপি পেয়েছিল ২৯.৪৯% ভোট, আসন পেয়েছিল ২৮টি এবং কংগ্রেস পেয়েছিল ২৪.৫৫ শতাংশ ভোট, আসন ৮টি। কংগ্রেস পার্টির সমর্থন নিয়ে সেবারই প্রথম দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন এএপি নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় দিল্লির ৭টি আসনই পেয়েছিল, ভোটও পেয়েছিল ৪৬.৪০ শতাংশ। কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ১৫.১০ শতাংশ ভোট, এএপি পেয়েছিল ৩২.৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে দিল্লিতে কংগ্রেসের ভোট কমলো ৪২.০১ শতাংশ, বিজেপির বাড়লো ১১.১৭ শতাংশ ভোট। অনুমান করা যায় যে, ২০১৪ সালে দিল্লিতে কংগ্রেসের হারানো ৩২.৯০ শতাংশ ভোট গেল এএপির দিকে, বাকি ১০ শতাংশ চলে গেল বিজেপির দিকে।

২০১৫ সালে দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে এএপি ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতেই জিতেছিল, কিন্তু ভোট পেয়েছিল ৫৪.৩০ শতাংশ। বিজেপি পেয়েছিল ৩টি আসন, ভোট পেয়েছিল ৩২.২০ শতাংশ। দিল্লির বিধানসভায় ২০১৫ সালে কংগ্রেস কোনো আসনই পেল না, ভোট পেল ৯.৭০ শতাংশ। অর্থাৎ ২ বছরের ব্যবধানে বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস ১৪.৮৫ শতাংশ দিল্লিবাসীর সমর্থন হারালো, বিজেপির সমর্থন প্রায় অপরিবর্তিতই রইলো, কিন্তু এএপির প্রতি ২৪.৮১ শতাংশ দিল্লিবাসীর সমর্থন বাড়লো।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি আবারও লোকসভায় দিল্লির ৭টি আসনই পেল, ভোট পেল ৫৬.৫৬ শতাংশ। কংগ্রেসের ভোট ২২.৫১ শতাংশ এবং এএপির ভোট ১৮.১১ শতাংশ। অর্থাৎ ৫ বছরের ব্যবধানে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের নির্বাচনে বিজেপির প্রতি ১০.১৬ শতাংশ দিল্লিবাসীর সমর্থন বাড়লো, কংগ্রেসের বাড়লো ৭.৪১ শতাংশ ভোট, কিন্তু এএপির প্রতি কমলো ১৪.৭৯ শতাংশ দিল্লিবাসীর সমর্থন।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ৯ মাস পর অনুষ্ঠিত গত ৮ ফেব্রুয়ারির বিধানসভা নির্বাচনে এএপি পেল ৬২টি আসন, ভোট পেল ৫৩.৫৭ শতাংশ। বিজেপি পেল ৮টি আসন, ভোট পেল ৩৮.৫১ শতাংশ। কংগ্রেসের যথারীতি কোনো আসন নেই, ভোটও পেল মাত্র ৪.২৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে এ-বছর বিজেপির প্রতি দিল্লিবাসীর সমর্থন বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ, আসনও বেড়েছে ১টি। এএপির প্রতি বরং দিল্লিবাসীর সমর্থন সামান্য [০.৭৩ শতাংশ] কমেছে। কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন কমেছে ৫.৪৪ শতাংশ দিল্লিবাসীর।

ভোটের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দিল্লিতে লোকসভা নির্বাচনগুলোতে বিজেপি বরাবরই বিধানসভা নির্বাচনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়েছে। যেমন, ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপি পেয়েছিল ৩৩.০৭ শতাংশ ভোট, কিন্তু পরের বছরই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই একই দিল্লিতে বিজেপি ৪৬.৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আবার ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপি ৩২.২০ শতাংশ ভোট পেলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ঠিকই ৫৬.৫৬ শতাংশ দিল্লিবাসীর সমর্থন পেয়েছিল।

পরিসংখ্যান থেকে এটাও স্পষ্ট যে, বিধানসভার ক্ষেত্রেও গত তিনটি নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপির সমর্থন মোটেও কমেনি, বরং ২০১৩ সালের চেয়ে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লিবাসীর কাছ থেকে বিজেপি ৫.৭৭ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। আর লোকসভা নির্বাচনে তো দিল্লিতে বিজেপির জয়জয়কার। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ২১.৩৩ শতাংশ বেশি দিল্লিবাসী নরেন্দ্র মোদীর গেরুয়া রাজনীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে!

দিল্লিতে মুসলিম ভোটার ১২ শতাংশ—যারা বিজেপিবিরোধী শিবিরের ভোট ব্যাংক হিসেবেই পরিচিত। নিশ্চিতভাবে ১২ শতাংশ দিল্লিবাসীর ভোট না পাওয়ার পরও দিল্লিতে বিজেপির ভোটের গ্রাফের ক্রমউত্থান বরং দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাফল্যের ইঙ্গিতবাহী।

দিল্লিবাসীদের ভোট পেতে কেজরিওয়াল সিএএ-এনআরসি নিয়ে কোনো জনসভায় একটি কথাও বলেননি। নাগরিকত্ব আইনবিরোধীদের শাহিনবাগের বিক্ষোভকে কেজরিওয়াল সমর্থন তো করেনই নি—উল্টো তিনি বলেছিলেন, দিল্লির পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না হয়ে তাঁর হাতে হলে তিনি দুই ঘণ্টায় শাহিনবাগ খালি করাতেন!

দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া-জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলার ঘটনায়ও কেজরিওয়াল মুখ খোলেননি। নিজেকে ভালো হিন্দু প্রমাণ করতে কেজরিওয়াল প্রকাশ্যে হনুমান চালিশা পাঠ করেছেন, ভোটের আগের দিন হনুমান মন্দিরে গিয়েছেন। ভোটে জিতেও কেজরিওয়াল হনুমান মন্দিরে গিয়েছেন এবং বলেছেন, হনুমানজী আমাদেরকে দয়া করেছেন! ভোটের অংক মিলাতে কেজরিওয়ালের এসব কৌশলও দিল্লিবাসীদের মনে হিন্দুত্ববাদ জেঁকে বসার ইঙ্গিত দেয়।

কোনো দলকে দিল্লিবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে—এটা যদি বলতেই হয়, তাহলে বলতে হবে সেই দলটির নাম কংগ্রেস! ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে প্রাপ্ত কংগ্রেসের ৫৭.১১ শতাংশ ভোট ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২২.৫১ শতাংশে নেমে গেছে। একইভাবে, ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লিতে প্রাপ্ত কংগ্রেসের ২৪.৫৫ শতাংশ ভোট ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৪.২৬ শতাংশে এসে ঠেকেছে!

সুতরাং দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনের এই ফলাফলকে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির জন্য কতটা বিপর্যয় বলা যাবে কিংবা বিধানসভার ভোটের হিসেবেও দিল্লিবাসী বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কতটা প্রত্যাখ্যান করেছে—সেটা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ। বরং গাণিতিক সংখ্যা প্রমাণ করে, কেন্দ্রীয় লোকসভা ও আঞ্চলিক বিধানসভা—উভয় নির্বাচনেই বিজেপির প্রতি দিল্লিবাসীর আস্থা ধাপে ধাপে বাড়ছে। পাশাপাশি দিল্লিবাসীদের রাজনৈতিক চিন্তায় হিন্দুত্ববাদ প্রবলভাবে অবস্থান গড়ে নিচ্ছে—এমনটাই স্পষ্ট হলো।

-শেখ ওমর শরীফ

Back to top button