জাতীয়

ফিরছে প্রবাসীরা, প্রকট হতে পারে বেকারত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক: লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন দেশে থাকা প্রায় ১৭ লাখ প্রবাসী কর্মী চাকুরি হারিয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে এসেছে এবং আসছে। আবার অনেকেই দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছে, বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে রফতানি করে বাংলাদেশের অর্থনীতির সিংহভাগই তাদের পাঠানো রেমিটেন্স নির্ভর তথা রফতানিনির্ভর ছিল। এখন হঠাৎ করেই এত সংখ্যক শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে আসলেও তাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই দেশে। ফলে বাংলাদেশে এসে বেকার জীবনযাপন করতে হবে তাদের। অন্যদিকে, রফতানিনির্ভর অর্থনীতিতে বিশাল আকারের একটি ধ্বস নামবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে ‘ডাচ ডিজিজ’ বলে একটি ধারনা আছে। ‘ডাচ ডিজিজ’ হলো যখন কোন দেশের অর্থনীতি একক কয়েকটি খাতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার লক্ষণ দৃশ্যমান। যাকে ‘কোয়াজি-ডাচ ডিজিজ’ বলা হয়। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে যা ব্যাপক অনিশ্চয়তার মধ্যে যাচ্ছে, কমছে রপ্তানি আয়। অন্যদিকে, প্রবাসী আয়ও কমছে। গত মে মাসে ২০১৯ সালের মে মাসের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম এসেছে প্রবাসী আয়। তেলের দাম মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মসংস্থান কমছে ও বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসছে। এমতাবস্থায় যদি এইসকল প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা যায় তাহলে তারা দেশে এসে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। জীবিকা হারিয়ে অসৎ পথেও পা বাড়াতে পারে এই শ্রমিকরা। এমন পরিস্থিতিতে যদি দেশের আভ্যন্তরিন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায় তাহলে এই বিপুল পরিমাণ ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকদের দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার কাজে নিয়োগ করানো যায়।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা-কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন সময়ে তাদের রফতানিকারক দেশগুলোতে থেকে অবরোধের সম্মুখীন হয়েছে। তখন এই দেশগুলো নিজেরাই তাদের দেশে পণ্য উৎপাদন করে নিজেদের দেশেই চাহিদার সৃষ্টি করে বড় বাজার সৃষ্টি করেছিলো। এতে করে অবরোধের ফলে তাদের আমদানি-রফতানি অর্থনীতির পরাজয় ঘটলেও তাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির কোনো ক্ষতি হয়নি। নিজেরাই সকল কিছু পুষিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অবরোধের সম্মুখীন না হলেও পরিস্থিতি ঠিক তেমনটিই দাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও আভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি করতে পারে।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাংলাদেশ শুধু কৃষিপণ্যের আমদানির জন্য বাৎসরিক ব্যয় করে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয়ভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু পর্যাপ্ত জনশক্তি ও প্রশিক্ষনের অভাবে সেই কৃষিপণ্যগুলোকে চাহিদামাফিক উৎপাদনে আনা যায়না। এক্ষেত্রে বিদেশফেরত এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

তথ্যানুযায়ী দেশে পুকুরের আকার ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ১২৭ একর, স্থায়ী পতিত জমি ১ কোটি ৬৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩৭ একর ও স্থায়ী পতিত জমি ৯ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার ২৩৭ একর। বিনিয়োগ ও কলাকৌশল প্রয়োগ করে এই জমিগুলোকে এই প্রবাসী শ্রমিকদের দিয়ে উৎপাদনে নিয়ে আসতে পারলে কৃষি উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশে প্রচুর সংখ্যক ডোবা, নালা, খাল ও মরা নদী আছে। এগুলো সংস্কার করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ পাড়ে সবজি চাষ সম্ভব। বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে কৃষি জমিতে সেচ হিসেবে ব্যবহার ও অন্যদিকে মাছ চাষের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সম্ভব। দেশের গড় শস্য নিবিড়তা ২০১৮ সালের হিসাব মতে ১৯৮। তার অর্থ হলে মোট আবাদকৃত জমিতে ফসল ফলানো হয় গড়ে ২ এর চেয়ে কম সংখ্যক। এক ফসলি জমি চাষযোগ্য জমির তিন ভাগের একভাগ। বর্তমানে এক ফসলি জমির পরিমাণ ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার একর। এই বিপুল পরিমাণ জমিকে কেনো দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যায়নি বা কীভাবে করা যায় তার জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তার ব্যবহার নিশ্চিত পারলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।

বিশেষ করে দেশে কম পরিমাণে উৎপাদন হওয়ার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে যেসব পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করতে হয় সেসব পণ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশ সরকার এই বিপুল সংখ্যক বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের কাজে লাগাতে পারে। পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, বিভিন্ন খাতের অ্যাক্সেসরিজ, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাট সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চশমা, যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় প্রতিবছর। কিন্তু এইসকল খাতের সকল চাহিদা দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমেই পুরন করা সম্ভব। সরকার এক্ষেত্রে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরী করে সেখানে এসব আমদানিনির্ভর পণ্যগুলো চিহিৃত করে কলকারখানা তৈরী করে সেসব কলকারখানায় এসব পণ্য তৈরীর উদ্যোগ নেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং বাজেট বরাদ্দ করে তাহলে এই শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের আর কোনো বাধা রইলো না। পাশাপাশি তাদের নিয়ে দেশের উন্নতিও সাধিত হলো।

Back to top button