অন্যরকমপাঁচমিশালি

৫২৬ বছরের পোড়ামাটির ঐতিহাসিক খেরুর মসজিদ

অনলাইন ডেস্ক: বাংলার সুলতানি আমলের এক স্থাপত্য। মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুর থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দূরে উত্তরের দিকে আছে একটি ছোট্ট গ্রাম।

যার নাম খেরুর। বাংলার আর পাঁচটা গ্রামের থেকে হয়তো তেমন কিছু আলাদা নয় এই খেরু। সবুজ ধান ক্ষেত, জল ভরা পুকুর, মাটির বাড়ি সবই আছে আর পাঁচটা বাড়ির মতো।

তবে এই খেরুকে আর পাঁচটা গ্রামের থেকে আলাদা করে দেয় খেরুর অবস্থিত প্রায় ৫২৬ বছরের প্রাচীন এক মসজিদ। সম্ভবত মুর্শিদাবাদ জেলায় সেটিই সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। আজ সেই মসজিদ সম্পর্কে জানাবো।

ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার অন্তর্গত খেরুর গ্রামের উত্তর পূর্ব কোণে দু একর বিস্তৃত এবং আনুমানিক তিন মিটার উচু একটি টিলার উপর অবস্থিত। এটি হোসেন শাহী আমলে নির্মিত।

গ্রামটি বিভিন্ন নামে যথা- খেরুর, খেরুল অথবা খেরাউল নামে অভিহিত। বেরহামপুর ও ফারাক্কার মধ্যবর্তী শেকের দিঘির প্রায় ৫ কি.মি. দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত।

মুর্শিদাবাদের মোড়গ্রাম রেল স্টেশন থেকে প্রায় ১৪-১৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত এই গ্রামটি। সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বও অপরিসীম। কৃষ্ণলোহীত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া গিয়েছে এই গ্রামে।

গুপ্ত যুগ ও তার আগের সময় কালের প্রাচীন ইটের সন্ধানও মিলেছে এখানে। গত ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খেরুর গ্রামে একটি বাড়ির ভিত খুঁড়তে গিয়ে মজুরেরা একটি কষ্টি পাথরের সুন্দর বিষ্ণুমূর্তি পেয়েছিল। মূর্তিটি পালযুগে তৈরি।

পেশাদার ইতিহাসবিদ দ্বারা এই গ্রামে প্রত্ন অনুসন্ধান করলে হয়তো আরও অনেক কিছু প্রাচীন ইতিহাস বেড়িয়ে আসবে। হোসেন শাহের রাজত্বকালে তার দরবারের তিনজন পদস্থ কর্মচারী এই অঞ্চলে বসবাস করতেন।

খেরুর মসজিদের শিলালিপি অনুসারে, মসজিদটি ৯০০ হিজরা বা ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে হোসেন শাহের রাজত্ব মুয়াজ্জিন রিফাত খাঁর ওই মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদে আরও একটি আরবী শিলালিপি ছিল। তাতেও মুয়াজ্জিন রিফাত খাঁর নাম ছিল।

তিনি সম্ভবত হোসেন শাহের সেনাপতি ছিলেন। প্রাক মুঘল যুগের স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হলো এই খেরুর মসজিদ। ওই মসজিদের সঙ্গে গৌড়ের মসজিদের গঠন রীতিতে সামঞ্জস্য আছে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুর্শিদাবাদে একমাত্র এই খেরুর মসজিদেই পোড়ামাটির অলঙ্করণ দেখতে পাওয়া যায়। এর স্থাপত্য রীতিতে লতা-পাতা-গুল্ম এবং গোলাপ ফুলের অলঙ্করণ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।

আচ্ছাদিত আয়তাকৃতির কাঠামোর মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে ইটের তৈরি এবং এতে পাথরের কোনো আবরণ নেই। চার কোণার চারটি মিনারসহ এ মসজিদদে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি ইবাদত কক্ষ এবং তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বারান্দা আছে।

যাই হোক, পাথরের টুকরাসমূহ যা সম্ভবত পূর্বেকার কোনো কাঠামো হতে সংগ্রহ করা হয়েছিল। বারান্দা ও ইবাদত কক্ষে সরদল, স্তম্ভ ও পোস্তায় ব্যবহার করা হয়েছে। মূল প্রার্থনা কক্ষের গোলাকার গম্বুজটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধসে যায়।

তবে সামনের বারান্দার তিনটি গম্বুজ মোটামুটিভাবে অক্ষত আছে। উত্তর-পশ্চিম কোণের মিনারটি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে অন্য তিনটি মিনার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।

মূল প্রার্থনা কক্ষ অভিমুখী স্তম্ভাবলম্বিত বারান্দার তিনটি খিলানপথের মধ্য দিয়ে পূর্ব দিক থেকে মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায়। প্রার্থনা কক্ষটি পরিমাপে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় নয় মিটার।

বারান্দা ও প্রার্থনা কক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি অতিরিক্ত প্রবেশ পথ আছে। কিবলা দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধবৃত্তকার কুলুঙ্গি। এর মধ্যে মাঝেরটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। দক্ষিণ দিকের মিহরাবটি ভালো অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।

তবে মাঝের ও উত্তর দিকের মিহরাব দুটি নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদের অলংকরণ পরিকল্পনা, যার জন্য এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বাস্তবায়িত করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে ইট দিয়ে। শুধু ব্যতিক্রম হলো আটটি পোস্তা। এগুলো পাথরের তৈরি।

মসজিদটি প্রাক-মুঘল মসজিদের বর্গাকার গম্বুজ রীতির মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। এ মসজিদের সম্মুখে একটি বারান্দা আছে। এ রীতি বাংলা সালতানাতের পরবর্তী ইলিয়াস শাহে শাসনামলে বিকাশ লাভ করে।

এর উদাহরণ দেখা যায় গৌড়ের চামকাটি মসজিদ, লট্টন মসজিদ ও রাজবিবি মসজিদ, দিনাজপুরের গোপালগঞ্জ মসজিদ, সুরা মসজিদ ও রুকন খান মসজিদ, বাগেরহাটের মসজিদবাড়ি মসজিদ ইত্যাদিতে।

কিবলা দেওয়ালটি ইট রেলিফ নকশায় অতিসুন্দর ও মনোরমভাবে অলঙ্কৃত। এ ধরনের অলঙ্করণ গৌড়ের ধুনিচক মসজিদের অলংকরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পশ্চিমদিকের বাইরের দেওয়ালে তিনটি অনুভূমিক আলংকারিক বন্ধনী রয়েছে।

এর নিম্নাংশে আছে জটিল নকশা এবং উপরাংশে রয়েছে চমৎকার খোপ নকশা। অনুরূপ পোড়ামাটির খোপনকশা উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের অভ্যন্তরে এবং ফাসাদের বাম পার্শ্বে এখনও বিদ্যমান। বক্রাকারে ইটের কারুকার্যের নিদর্শনসমূহ বাইরের অন্যান্য দেওয়ালের চারদিকে অল্প করে দেখা যায়।

অলঙ্করণ পরিকল্পনায় প্রধানত ফুলেল নকশা দেখা যায় এবং এর মধ্যে গোলাপ প্রাধান্য পেয়েছে। মসজিদের নিকটে গাজী পীর কল্লার সমাধির ইটের সমতল ছাদের নিচে পড়ে থাকা মসজিদের দুটি উৎসর্গকৃত আরবি শিলালিপি পাওয়া গেছে।

শিলালিপি দুটি পেয়েছিলেন টি. ব্লক (১৯০৫)। পরবর্তীকালে সংরক্ষণ কাজের সময়ে শিলালিপি দুটিকে ফাসাদে লাগানো হয়। মসজিদটি ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের আওতায় একটি সংরক্ষিত নিদর্শন।

১৯৯২ সালে টিলাটির চারপাশে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো হয় এবং কাছের একটি পুকুরের উত্তর পাড় খনন করা হয়।

এর ফলে কালো রঙের মাটির পাত্রাদির ভাঙ্গা টুকরা এবং লাল রঙের পণ্য সামগ্রীসমূহ, ধূসর ও বাদামি পণ্য, লৌহ খণ্ড, ছোট ছোট পাথর খণ্ড, গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী যুগের ইট (৪র্থ-৭ম শতক), পাল আমলের কালো পাথরের আয়তাকার চৌহদ্দি নির্দেশক (মার্কার) পাওয়া গেছে।

এছাড়া ১৯৭৮ সালে এ গ্রামে পাল-সেন যুগের কালো পাথরের বিষ্ণুর মূর্তি পাওয়া গেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, আদি ঐতিহাসিকাল থেকেই এ এলাকায় ধারাবাহিকভাবে কম বেশি মানুষের বসবাস ছিল।

Back to top button