ইসলামইসলাম শিক্ষা

আজ ১৪ই যিলহজ্জ : চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঐতিহাসিক দিবস

 

আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের ৬ষ্ঠ বছর সুমহান ১৪ই যিলহজ্জ রাতে পবিত্র মক্কা শরীফে আবূ জাহিল, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, আছ ইবনে ওয়াইল প্রমুখ কুরাইশ কাফিররা সমবেত হয় এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুাবরকে উপস্থিত হয়ে আবেদন জানায় যে, আপনি যদি সত্য নবী হয়ে থাকেন তাহলে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করে দিন। তিনি বললেন, আমি যদি (তোমাদের দাবী অনুযায়ী) এরূপ করে দিতে পারি তা হলে তোমরা কি ঈমান আনবে? তারা বলল, হাঁ, আমরা ঈমান আনব। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট এরূপ হওয়ার জন্য দোয়া মুবারক করলেন। অর্থাৎ চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার জন্য দোয়া মুবারক করলেন। তখন উনার নির্দেশ মুবারকে চাঁদ দুই টুকরা হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রত্যেক কাফিরের (উপস্থিত) নাম উচ্চারণ করে বলতে থাকেন, হে অমুক! হে অমুক!! সাক্ষী থাক। তখন উপস্থিত সকল লোকেই উত্তমরূপে প্রত্যক্ষ করল যে উভয় খণ্ড- এতই পার্থক্য হয়ে গিয়েছিল যে, উভয়ের মাঝে হেরা পর্বত দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। কাফিররা বলে উঠল, এটা হচ্ছে উনার জাদু। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ!

কাট্টা কাফির আবূ জাহিল বলল, এটা জাদু হলে জাদুর প্রভাব কেবল তোমাদের উপরই পড়ার কথা, এটাতো হতে পারে না যে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর পড়বে। আবূ জাহিল আরো বলল, শহরের লোকেরা যারা তোমাদের নিকট আসবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এবং বিভিন্ন দিক দিগন্ত হতে যারা আসবে তাদেরকেও জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাদের আগমনের পর সকলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা সবাই বলল যে, আমরা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করেছি।

পবিত্র হাদীছ সংকলনের তৃতীয় যুগের মুহাদ্দিছীনে কিরাম উনাদের মধ্যে একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ হচ্ছেন হযরত আবূ নুয়াইম আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ ইস্পাহানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার সংকলিত ‘দালায়িলুন নুবুওওয়াহ’ নামক প্রসিদ্ধ হাদীছ গ্রন্থ উনার মধ্যে হযরত আতা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত জোহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ বর্ণনায় পূর্বে উল্লেখিত তিনজন কাফির নেতা ছাড়াও আছ ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব এবং নজর ইবনে হারিছের নামও রয়েছে যারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট উপস্থিত হয়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার দাবি জানিয়েছিল। এই বর্ণনায় তারা স্পষ্ট দাবি জানিয়েছিল। কাফিরেরা বলল, আপনি যদি সত্যবাদী হন তাহলে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে আমাদেরকে দেখান, যার অর্ধেক আবূ কুবাইস পর্বতে এবং অর্ধেক কাইকুআন পর্বতে পতিত হবে। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আমি যদি তা করে দেই তাহলে তোমরা ঈমান আনবে কি? তারা বললো, হ্যাঁ। বর্ণনাকারী বলেন, রাতটি ছিল জ্যোৎসনার। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র দরবারে দোয়া করেন, তারা (কাফিররা) যা চায় তা যেন মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাকে হাদিয়া মুবারক করেন। অতঃপর চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে অর্ধেক আবূ কুবাইস পর্বতে পতিত হয় এবং অর্ধেক কাইকুআন পর্বতে পতিত হয়। সুবহানাল্লাহ! তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে আবূ সালমা, হে আবদুল আসাদ এবং হে আরকাম ইবনে আরকাম, তোমরা সবাই সাক্ষী থাক। এ বর্ণনা হতে জানা যায় যে, কাফিরদের পক্ষ হতেই দাবী করা হয়েছিল যে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করে উল্লেখিত দুই পর্বতে পতিত করতে হবে।

মূর্খ ও জাহিল গ্রীক দার্শনিকদের একটি দল তারা কাফির-মুশরিকদেরও ছাড়িয়ে যায় এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মু’জিযা শরীফ উনাকে অস্বীকারই করে না, তারা তাদের ভ্রান্ত নীতি দর্শন অনুযায়ী বলতে থাকে, আকাশ ও গ্রহ-উপগ্রহের পক্ষে বিদীর্ণ হওয়া ও সংযুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! তারা আরও প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মতো মু’জিযা শরীফ সংঘটিত হয়ে থাকলে তা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পেত। অথচ ইতিহাসে এই ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! সুতরাং এই ঘটনার কোন বাস্তবতা নেই। তাছাড়া গণক, জ্যোতিষীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেনি, ভবিষ্যৎ বক্তারাও এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। এ ধরনের নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে দার্শনিক-বিজ্ঞানীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সত্য ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা কম করেনি। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! এ ব্যাপারে তারা গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে একশ্রেণীর মুসলিম সীরাত লেখককেও বিভ্রান্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার জন্য কোনো কোনো সীরাত গ্রন্থে শাক্কাল ক্বমারের মু’জিযা শরীফ সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ!

চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পায়নি বলে দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের অভিযোগ যে কত ভিত্তিহীন তা নিম্নের আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

১ ‘শাক্কাল ক্বমারে’র মু’জিযা শরীফ পবিত্র মক্কা শরীফ উনার কাফিরদের একটি বিশেষ দাবির প্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়েছিল। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেই দাবী পূরণ করার জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্র দরবারে দোয়া মুবারক করেন এবং মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার সেই দোয়া মুবারক কবুল করেন। সুবহানাল্লাহ!

২. পবিত্র মক্কাবাসী উনারা ছাড়াও আশপাশের এলাকা হতে আগত মুসাফিরগণও চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সাক্ষ্য দান করেন। সুবহানাল্লাহ!

৩. যদি ধরেও নেয়া যায় যে, ঘটনাটি সকল স্থানে দেখা যায়নি এর কারণ কি? জবাবে বলা যায় চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্যের কারণে কোন কোন স্থানে চাঁদ উদিতই হয়নি। এ জন্য চন্দ্র গ্রহণ সব স্থানে পরিলক্ষিত হয় না এবং কোন কোন সময় অন্যান্য স্থানে মেঘাচ্ছন্ন বা পর্বত ইত্যাদি চাঁদের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।

৪. ‘খিরকে ইলতিয়াম’- একটি বিশেষ পরিভাষা। খিরক অর্থ হচ্ছে ফেটে যাওয়া, চিরাচরিত নিয়মনীতি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছু ঘটে যাওয়া, ব্যতিক্রম, অভিনব, হযরত নবী রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের পবিত্র মু’জিযা শরীফ বা অলৌকিক ঘটনা। এর বহু বচন খাওয়ারিকা। আর ইলতিয়াম শব্দের অর্থ, পরস্পর দুই বস্তুর মিলিত হওয়া। সুতরাং খিরকে ইলতিয়াম বলা হয়, সৌরমণ্ডলে অর্থাৎ আকাশ, তারকারাজি তথা গ্রহ-উপগ্রহ ইত্যাদি ফাটল-মিলন বা ব্যতিক্রমী ঘটনাবলী। মুসলমানদের কাছে আকাশ নক্ষত্ররাজির মধ্যে এসব অবস্থার সৃষ্টি হওয়া খুবই সম্ভব। এর বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, ক্বিয়ামতের সময় আসমান ও তারকারাজি ফেটে তুলাতুলা হয়ে যাবে যার বর্ণনা পবিত্র কুররআন শরীফ উনার বহু স্থানে রয়েছে। এ ব্যাপারে বহু পবিত্র হাদীছ এ বর্ণনা এসেছে। ‘হিকমত’ বা যুক্তিশাস্ত্র অনুযায়ী ও দার্শনিকদের যুক্তি বাতিল-অচল এ সম্পর্কে গ্রীসের বিখ্যাত প্রাচীন দার্শনিক ফিসাব্যারাম ‘হাইয়াত’ বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে, তারকারাজি মৃত্তিকার ন্যায় খুব ঘন, পুরু এবং সমস্তই লীন, ধ্বংসযোগ্য এবং তাদেরও ফাটল-মিলন ঘটবে। অতএব বিনাদ্বিধায় প্রমাণিত যে, চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা একটি অকাট্য সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত, এতে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।

৫. প্রাচীন ঐশী গ্রন্থ ‘তাওরাত শরীফ-এ’ বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইউশা বিন নূন আলাইহিস সালাম উনার জন্য চলমান সুর্য থেমে গিয়েছিল, অথচ এ ঘটনা কোন ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত হয়নি, যদিও এটি ছিল দিনের ঘটনা। সুতরাং ঘটনাটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ না থাকলে তার বাস্তবতা মিথ্যা হতে পারে না। কাজেই রাতের ঘটনা ‘শাক্কাল ক্বমারকেও’ অস্বীকার করা যায় না। মুসলমান ঐতিহাসিকদের আরবী, ফার্সী, উর্দু, বাংলাসহ বিশ্বের নানা ভাষায় রচিত প্রাচীন ও আধুনিক বহু গ্রন্থে এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র মু’জিযা শরীফ সংক্রান্ত পবিত্র হাদীছ ও অন্যান্য অসংখ্য গ্রন্থে, পদ্যে-গদ্যে শাক্কাল ক্বমারের ঘটনার বিবরণ, আভাস, ইঙ্গিত ছাড়াও পবিত্র কুরআন শরীফে পবিত্র সূরা ক্বমার ’ অপেক্ষা বড় দলীল আর কি হতে পারে!

৬. শাক্কাল ক্বমারের পবিত্র মু’জিযা শরীফ অস্বীকারকারী আধুনিক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যে প্রত্যেকেই চাঁদে মানব অবতরণের বিস্ময়কর ঘটনা অবগত। বিশ্ব ইতিহাসের এই চমকপ্রদ ঘটনাটি সর্বপ্রথম ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই রাত ২টা ১৬ মিনিটে। চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানব চাঁদের ক্ষত চিহ্নের যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তা কেউ এখনও ভুলে যায়নি। এর পরেও কি অস্বীকারকারীদের বোধোদয় হবে না?

৭. মালাবারের রাজা চেরুমল পেরুমল এবং গুজরাটের রাজা ভোজের সম্মানিত দ্বীন ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ছিল শাক্কাল ক্বমার বা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার ফল। সুবহানাল্লাহ!

কাজেই, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিষয় নিয়ে যারা চু-চেরা ক্বীল ও ক্বাল করে বা সামান্য সন্দেহ পোষণ করে বা করবে তারা কাট্টা কাফিরের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও পবিত্র হাদীছ দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।

 

লেখক ও গবেষক

আল্লামা মুহম্মদ আবুল খায়ের

 

Back to top button