কৃষি

দেশে এলো আখ কাটার মেশিন, ৪০ শ্রমিকের কাজ করবে ১ ঘণ্টায়

নিউজ ডেস্ক: মানুষের স্পর্শ ছাড়াই আখখেত থেকে হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে লম্বা লম্বা আখ কাটা শেষে ভরে যাচ্ছে পাশের ট্রলি। আর আখের পাতাগুলো একটি পাইপের মাধ্যমে গুঁড়া হয়ে পড়ছে বাইরে।

এমন বিস্ময়কর দৃশ্য ভারতসহ উন্নত দেশে দেখা গেলেও এই প্রথম দেখা মিলল দেশের সিমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গাতে।

যেখানে মেশিনের মাধ্যমে ৩৫-৪০ শ্রমিকের ২০ টন আখ কাটতে সময় লাগে মাত্র এক দিন। কিন্তু হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে এক একর পরিমাণ জমির আখ কাটতে খরচ পড়বে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। শ্রমিক দ্বারা একর প্রতি জমির আখ কাটতে প্রায় ১১ হাজার টাকার মতো খরচ হয় আখ চাষির। অথচ এই মেশিনে একর প্রতি সাশ্রয় হবে ৭-৮ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, প্রতি ঘণ্টায় এই হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে ২০ টন আখ কর্তন করা সম্ভব। এতে চিনি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানার উদ্যোগে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে এই হারভেস্টার মেশিনটি উপহার হিসেবে দিয়েছে আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান আলীম ইন্ডাস্ট্রিজ। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো ভারত থেকে মেশিন দেশে আমদানি করেছে। এছাড়াও মেশিন চালানো শেখাতে চিনিকল শ্রমিকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা। এরই ধারাবাহিকতায় চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম চিনি কল কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের খামারে পরীক্ষামূলকভাবে আখ কর্তন করা হয়েছে।

জেলার জীবননগর উপজেলার ধোপাখালি গ্রামের এক আখ চাষি বলেন, এই মেশিনের মাধ্যমে আখ কাটা দেখেছি। পরিষ্কার-পরিছন্নভাবে আখগুলো ছোট ছোট টুকরো হয়ে বের হয়। এর আগে লোকমুখে শুনেছি, এই প্রথম চোখে দেখলাম। অনেক চাষি আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এই প্রযুক্তি (হারভেস্টার মেশিন) যদি কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মিলে যুক্ত হয় তাহলে চুয়াডাঙ্গায় প্রচুর চাষি আখ চাষে আগ্রহী হবে। শুধু চুয়াডাঙ্গায় নয় সারাদেশের কৃষক আখ চাষে আগ্রহী হবে বলে মনে করি।

রবিউল নামে এক আখ চাষি বলেন, এই প্রথম আখ কাটার হারভেস্টার মেশিনটি দেখলাম আমরা। অনেক উন্নতমানের মেশিন এটা। ৪০ জন এক দিনে যে পরিমাণ আখ কাটতে পারে এই মেশিনটি মাত্র এক ঘণ্টায় সেই পরিমাণ আখ কাটতে পারে। এতে অনেক সুযোগ-সুবিধা বলে জেনেছি। চাষিদের খরচ কম হবে এবং শ্রমিকদের সময় বাঁচবে। আখ কর্তনের সময় শ্রমিক পেতে ব্যাপক সমস্যায় ভুগতে হয় চাষিদের। সেই কারণে অনেকে আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই মেশিন এলে অধিকাংশ কৃষক আখ চাষ করবেন। এতে চিনি উৎপাদনও বাড়বে।

আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান আলীম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার কৃষি প্রকৌশলী হুমায়ন কবির বলেন, এই মেশিনের চারটি গুণাগুণ রয়েছে। এক একর জমির আখ কর্তন করতে ৩৫-৪০ জন শ্রমিকের সারাদিন লাগবে। সেখানে এই হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে কর্তন করলে মাত্র এক ঘণ্টা লাগবে। যেখানে শ্রমিক প্রতি ৫শ টাকা মজুরি হলে ৪০ শ্রমিকের জন্য ২০ হাজার টাকা লাগে। সেখানে এই মেশিনের মাধ্যমে কাটলে ২ হাজার টাকা অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ হবে। হাত দিয়ে যখন আখ কাটা হয় তখন গোড়া থেকে ২-৩ ইঞ্চি উপর দিয়ে কাটে। এতে আখের সুগার নষ্ট হয়ে যায়, সেই সঙ্গে আখ পরিষ্কারও ঠিকমতো হয় না। আর এই মেশিন আখের গোড়া থেকে কর্তন করা যাবে। একই সঙ্গে আখ পরিষ্কার-পরিছন্ন হয়ে বের হবে।

তিনি আরও বলেন, আখ কাটতে শ্রমিকদের অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এই মেশিন থাকলে তাদের কষ্ট লাগব হবে। ভারতের গুজরাটের একটি কোম্পানি থেকে আমদানি করা হয়। আমরা এই মেশিনটির দুই বছরের ওয়ারেন্টি দেব। যে কোম্পানি থেকে নেওয়া হয়েছে সেখানের টেকনিশিয়ান এবং প্রকৌশলীদের মাধ্যমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) আরিফুর রহমান অপু বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে কৃষিতে শ্রম কমিয়ে সবকিছুতেই যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। চাষাবাদ, বীজ বপন, নিড়ানি, সার দেওয়া, ফসল কাটা, মাড়াই, ঝাড়া এমনকি প্যাকেটিং পর্যন্ত সবই হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ফলে একদিকে যেমন উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে অন্যদিকে তেমনি উৎপাদন ব্যয় ও সময় কমছে। একই সঙ্গে ফসলের অপচয়ও কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দিন দিন আবাদী জমির পরিমাণ কমে আসছে। আবাদী জমি ব্যাপকহারে কমলেও কৃষি পণ্য উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হচ্ছে। এই সাফল্য অর্জনের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি।

আরিফুর রহমান অপু বলেন, আখ কাটার সময় শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এতে চাষিরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এখন থেকে আখ কাটার মৌসুমে নিশ্চিন্তে থাকবে চাষিরা। এই হারভেস্টার মেশিন ঘণ্টায় ২০ টন আখ কর্তন পারে। শ্রমিক দিয়ে এক একর জমির আখ কাটতে প্রায় ১১ হাজার টাকার মত খরচ পড়ে। সেই একই পরিমাণ আখ হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কাটলে খরচ পড়বে ৩ হাজার টাকা। এতে একর প্রতি সাশ্রয় হবে ৮ হাজার টাকা। শুধু তাইনয় হারভেস্টার দিয়ে আখ কাটতে পারলে চিনির রিকভারিও বৃদ্ধি পাবে। দেখা গেছে লেবার দিয়ে এক একর আখ কাটলে তাতে ফলন আসে ১৭ টন। মেশিন দিয়ে কাটলে ফলন হয় ২০ টন। ৩ টন আখের বাজার মূল্য ১৩ হাজার ৫শ টাকা।

দেশের বৃহত্তম চিনি কল কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, মৌসুমে আখ কর্তন করতে গেলে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। সব থেকে বড় সমস্যা শ্রমিক পাওয়া। এই মেশিন দিয়ে আখ কাটলে করলে সময়, শ্রমিক ও খরচ কমবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব ম্যাডাম এই হারভেস্টার মেশিনটি চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে উপহার দিয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির খামারে নিয়ে আখ কর্তন করা করা হয়েছে। এই হারভেস্টার মেশিনটি ভারতের নর্ট বেঙ্গলে চলে যাবে। এই বছরের মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লিমিডেট থেকে নিজস্বভাবে হারভেস্টার মেশিন ক্রয় করা হবে।

Back to top button