ভ্রমণ

সেন্টমার্টিনের অবস্থা খুবই নাজুক সাময়িকভাবে বন্ধ হচ্ছে পর্যটন

ক্রমাগত পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের ফলে অস্তিত্ব বিলীনের হুমকিতে থাকা দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে সাময়িকভাবে পর্যটন বন্ধ করে দ্বীপটি পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের মাধ্যমে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর মনে করছে, মাত্রাতিরিক্ত পর্যটনের কারণে সেন্টমার্টিনে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে সেখানে অন্তত আগামী তিন বছর সব পর্যটনকার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। এ সময় দ্বীপটি পুনর্গঠন তথা জীববৈচিত্র্য প্রতিস্থাপনের পর নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত পর্যটন চালুর মাধ্যমে দ্বীপকে রক্ষা করা যেতে পারে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা সেন্টমার্টিন সরেজমিন পরিদর্শন শেষে লিখিতভাবে সরকারকে জানান, সেন্টমার্টিনের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, সেখানে পর্যটন সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে জীববৈচিত্র্য সহায়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন না করলে দ্বীপটি সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

Image result for সেন্টমার্টিন

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, সেন্টমার্টিনে পর্যটন বেড়ে যাওয়ায় সেখানে অবৈধভাবে আবাসিক হোটেল মোটেলসহ পাকা স্থাপনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সেখানে ইট, বালু তথা পাকা গৃহ নির্মাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সাগর পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। আর তাই নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন আবাসিক হোটেল মোটেল। ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক আবাসিক হোটেল। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল দ্বীপে পরিবেশবিরোধী কাজ থামাতে গিয়ে শারীরিকভাবে প্রহৃত হন পরিবেশ কর্মকর্তারা। মূলত এর পর থেকেই সেখানে পরিবেশ অধিদফতরের কাজ বন্ধ থাকে। এই সুযোগে যে যার মতো করে দ্বীপে পরিবেশবিরোধী সব রকমের কাজ চালাতে থাকে। পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজার কার্যালয় থেকে ঢাকায় পাঠানো এক লিখিত প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, আবাসিক হোটেলের কক্ষ থেকে সাগরের দৃশ্য দেখার সুযোগ সৃষ্টি করতে দ্বীপের রক্ষা কবচ কেয়া গাছের প্রাকৃতিক বাউন্ডারি কেটে ধ্বংস করছেন হোটেল মালিকেরা।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিনকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। কিন্তু এ ঘোষণার সাথে আনুষঙ্গিক ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় শুধু ঘোষণার মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে। ওই সময় কক্সবাজারে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যালয় না থাকা এবং বিভাগীয় কার্যালয়ে অল্প লোকবল নিয়ে প্রায় দুই শ’ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপের দেখভাল করা কঠিন হয়ে পড়ে। তথাপিও ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে সে সময়ের পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক অ্যানফোর্সম্যান্ট মুনির চৌধুরী আকস্মিক অভিযানে গিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ অংশে অবৈধভাবে নির্মিত রিসোর্ট ‘কোকনাট কোরাল’ ভেঙে দেন। এ ছাড়া ব্লু মেরিন নামক নির্মাণাধীন হোটেলকে দশ লাখ, প্রিন্স হেভেনকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা করেন।

তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জাফর আলম দ্বীপের পূর্ব পাড়ায় সৈয়দ আলম কর্তৃক নির্মিত স্থাপনা ভেঙে দিয়ে ৩২ লাখ টাকা, সি ইন হোটেলকে ৩৬ লাখ টাকা, লাবিবা রিসোর্টকে কেয়াবন ধ্বংসের দায়ে ৩৬ লাখ টাকা এবং ভবন নির্মাণের দায়ে ২৭ লাখ টাকা, পান্না রিসোর্টকে ৩ লাখ টাকা, নীল দিগন্ত রিসোর্টকে বালিয়াড়ী নষ্ট ও কেয়াগাছ কর্তনের দায়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং পরে এসব জরিমানা আদায় করা হয়। এর পর থেকে ভবন বা হোটেল নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে না পারায় সৈকতে দোকান উচ্ছেদসহ দুই শতাধিক বৈদ্যুতিক বাতি জব্দ করা হয়। একই সময় দ্বীপে নির্মাণসামগ্রী পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। সবশেষ ২০১৩ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ ও অ্যানফোর্সম্যান্ট অভিযান পরিচালনা করতে গেলে বর্তমান চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ তার বাহিনী নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরের অ্যানফোর্সমেন্ট টিমের ওপর আক্রমণ করেন। ফলে অভিযান পণ্ড হয়ে যায়। এরপর দ্বীপে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। লিখিত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বর্তমান চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ নিজেই প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে তিনতলা ভবন নির্মাণ করেন এবং অন্যকে রাতের বেলায় সমুদ্রপথে নির্মাণসামগ্রী পাচার ও ভবন নির্মাণে সহযোগিতা করে আসছেন। ফলে দ্বীপে একের পর এক গড়ে উঠছে পাকা স্থাপনা।

দ্বীপের চেয়ারম্যান হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে দ্বীপ থেকেই আইনের প্রতিপালন করা সম্ভব হতো; কিন্তু তা মোটেও হচ্ছে না। এমতাবস্থায় যে যেভাবে পারছে পরিবেশবিধ্বংসী কাজকর্ম অব্যাহত রেখেছে। অপর দিকে সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এর ফলে এক দিকে সমুদ্রের পানি দূষণের ফলে কোরাল ধ্বংস হচ্ছে, অন্য দিকে হাজার হাজার পর্যটকের একসাথে সেন্টমার্টিন যাতায়াতের ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট ও দূষণ দু’টোই হচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। বর্তমানে দূষণের কারণে সেন্টমার্টিন সাগরে কোরালের ৮০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গণ উৎপাতের ফলে সামুদ্রিক কাছিম ডিম দিতে তীরে আসতে পারে না। প্রতিনিয়ত পাচার হচ্ছে প্রবাল শৈবাল। এভাবে চলতে থাকলে সেন্টমার্টিনে যেকোনো বড় অঘটন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করছে পরিবেশ অধিদফতর। তাই আগামী তিন বছর পর্যটন সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে দ্বীপ পুনর্গঠন তথা জীববৈচিত্র্য প্রতিস্থাপন করে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন চালুই দ্বীপকে রক্ষা করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দিকে দ্বীপের সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে পরিবেশ অধিদফতর ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষা প্রকল্প’ নামে ১৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানান সরদার শরিফুল ইসলাম।

এই প্রকল্পে কেয়াবন পুনর্নির্মাণ, কোরালের রিজেনারেশান ও কনজারভেশান, কোরাল সংগ্রহকারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পটি ইতোমধ্যে অনুমোদন হয়েছে এবং শিগগির প্রকল্প পরিচালক, কর্মকর্তাসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ হলেই কার্যক্রম শুরু হবে। শরিফের মতে, যেহেতু দ্বীপের উন্নয়ন ও দ্বীপটি রক্ষায় সরকারি দফতরগুলোর মধ্যে আন্তঃসমন্বয় নেই, সেহেতু কোনো একটি মাত্র সরকারি সংস্থাকে দ্বীপটি পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। অন্যথায় সমন্বয়হীনতার কারণে দ্বীপটি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Back to top button