ঐতিহ্যবাহী মসলিনের গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁতশিল্পকে আরও আধুনিক ও বহুমুখীকরণ করা হবে। এই শিল্পের প্রসারে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপই তার সরকার নেবে। গতকাল রোববার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ তাঁতী লীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মসলিনের ওপর চার ইঞ্চি জরির কাজ করতে পুরো দিন লেগে যায়। এই যে তারা মনোযোগ দিয়ে একটি বস্ত্র তৈরি করছেন, এটাও তো একটি অত্যন্ত উন্নত মানের শিল্প। কাজেই এটাকে আরও বেশি সহযোগিতা করার জন্য আমাদের সরকার সব সময় প্রস্তুত এবং আমরা তা করে যাব। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডকে ডিজিটালাইজড করার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে দেশে একটি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই শিল্প যেন আরও উন্নত হয়, স¤প্রসারিত হয়, সেদিকেই নজর দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় দেশে তৈরি কাপড়, বিশেষ করে তাঁতীদের বোনা কাপড়ের প্রশংসা করেন। তিনি নিজে সবসময় বাংলাদেশে তৈরি কাপড় পরেন জানিয়ে নারী-পুরুষ সবাইকে দেশে তৈরি পোশাক পরারও পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, সবাই লক্ষ্য করেছেন, তাঁতী ভাইয়েরা লক্ষ্য করেছেন, আমি কিন্তু কখনো ফ্রেঞ্চ শিপন পরি না। বাংলাদেশে তৈরি, আমাদের তাঁতীদেও তৈরি কাপড়ই সব সময় ব্যবহার করি। এটা সুতির কাপড় হোক, সিল্কের কাপড়, এমনকি খদ্দর শাড়ি আছে তাও পরি। বিদেশে যত উপহার দেই। সেখানে উপহারের খাতায় কিন্তু সব সময় দেশে তৈরি কাপড় রাখি, উপহার দিয়ে থাকি।
নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও তাঁতীদের বোনা কাপড় ব্যবহারে উৎসাহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শাড়ি আমরা পরি। আমার তো মনে হয় ছেলেরাও শার্ট, পাঞ্জাবি সবকিছু তাঁতীদের তৈরি কাপড় থেকে পরতে পারে। এগুলো দেখতেও সুন্দর। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরও উন্নত মানের খদ্দর কাপড় কিনে দেই, পাঞ্জাবিও কিনে দেই তারা পরে।
খদ্দর কাপড়ের প্রশংসা করে তিনি বলেন, খদ্দরের তৈরি কাপড় আমাদের দেশে আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য আরামদায়ক। খদ্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শিল্প। খদ্দরের তৈরি কাপড় এক সময় দেশে ফ্যাশন ছিলো। কিভাবে যেন সেই চাহিদা ও গুরুত্ব হারিয়ে যেতে বসলো। আশা করছি পুরনো সেই ঐতিহ্য ফিরে আসবে।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ তাঁতী লীগের আহ্বায়ক এনায়েতুর রহমান চৌধুরী। স্বাগত বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ তাঁতী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাধনা দাস গুপ্তা। প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক খগেন চন্দ্র দেবনাথ সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সকল শহীদ, কারাগারে নিহত জাতীয় চারনেতা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, গণতন্ত্র উদ্ধারে আত্মাহুতিদানকারী তাঁতী লীগের প্রয়াত নেতৃবৃন্দ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে আবার ফিরিয়ে আনায় তার সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, সারা বাংলাদেশে আমরা একটা সমীক্ষা করছি যে, মসলিন কোন কোন এলাকায় তৈরি হতো, এর সুতা আবার পাওয়া যায় কিনা এজন্য আমরা গবেষণা করছি। প্রধানমন্ত্রী তাঁত শিল্পের প্রসারে তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ৪২৬টি তাঁতের বিপরীতে ১৪২ জন তাঁতীকে ৪৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তাঁতীদের প্রশিক্ষণের জন্য নরসিংদীর তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে আমরা আরো উন্নত করেছি। সেখানে ৪ বছর মেয়াদে ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল কোর্স চালু করা হয়েছে এবং এতে ভর্তির ক্ষেত্রেও তাঁতী পরিবারের সদস্যদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা নতুন নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ৪১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ফ্যাশন ডিজাইন ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং একটি বেসিক সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। প্রকল্পের আওতায় নরসিংদীতে একটি ফ্যাশন ডিজাইন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ প্রায় ৯৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি, টাঙ্গাইল এবং মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে একটি করে তিনটি প্রশিক্ষণ উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, পাশাপাশি স্বতন্ত্র জামদানি পল্লী, বেনারসি পল্লী ও তাঁত পল্লী স্থাপনেরও কাজ চলছে। নারায়ণগঞ্জের তারাবোতে ক্ষুদ্র তাঁতীদের জন্য প্লট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তাঁতীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁতীদের কল্যাণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। বাজেটে সুতা ও রং আমদানি ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর রহিত করা হয়েছে। যাতে দাম কমে। মাদারিপুরের শিবচর এবং শরিয়তপুরের জাজিরায় ১শ’ ২০ একর জমিতে তাঁত পল্লী স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সিলেটে মণিপুরী তাঁত শিল্পের উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে ৬শ’ মণিপুরী তাঁত শিল্পীকে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ তাদের পণ্য বিক্রিতে সিলেটের জিন্দাবাজারের ‘ওয়েস্ট ওয়াল্ড শপিং সিটিতে’ একটি বিপণী কেন্দ্র খোলা হয়েছে। রংপুরের শতরঞ্জি এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। সেখানে বেসিক সেন্টার এবং প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
তাঁত শিল্প চরম অবহেলার স্বীকার উল্লেখ করে তাদের ভাগ্যোন্নয়নে সংগঠন নেতৃবৃন্দকে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংগঠন মানে কিন্তু কেবল নেতা হয়ে বসে থাকা নয়।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ’৯৬ সালে তাঁর সরকার গঠনের পর সরকারের নানামুখী উদ্যোগে তাঁতশিল্প, সিল্ক শিল্প গড়ে ওঠে এবং এক সময় সেই শিল্প হারিয়ে যায় বলেও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে তাঁতী লীগের সম্মেলন হচ্ছে, নতুন নেতৃত্ব আসবে। আপনারাই আপনাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন এবং তাঁতীদের দিকে দৃষ্টি দেবেন এবং বংশ পরম্পরায় তাদের মেধাকে কাজে লাগাবেন। তাঁতী পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া শেখার পাশাপাশি তাদের এই শিল্পের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার বিষয়েও উদ্যোগী হবার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশ জামদানির পেটেন্ট রাইটস অর্জন করায় এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা এবং পাশাপাশি তাঁত ও সিল্ক শিল্প যেন বিশ্বব্যাপী প্রসার লাভ করতে পারে তার জন্য সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মুখ্য দায়িত্ব হবে তাঁত শিল্পের বাজার স¤প্রসারণ করা।