শিক্ষা

বেশি দামের কাগজ বেচে কম দামের কাগজে ছাপছে বই

Image result for এনটিসিবি বই

আগামী বছরের পাঠ্যবই নিম্নমানের কালি ও কাগজে ছাপানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে কাগজের পুরুত্ব, উজ্জ্বলতা ও বাঁধাইয়ের মান নিয়েও। প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব বইয়ের ক্ষেত্রেই কম-বেশি একই চিত্র। নবম শ্রেণীর বাংলা, ইংরেজিসহ ১২টি পাঠ্যবইয়ের মুদ্রণকাজ এখনও পুরোপুরি শুরু করা হয়নি। এমনকি আগামী ১৯ নভেম্বরের আগে এর কোনো লক্ষণ নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিকের সব এবং নবম শ্রেণীর ১২টি পাঠ্যবই এবার চার রঙে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু ওইসব বইয়ের ছবি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় না সেগুলোতে আসলে কিসের ছবি। পাতায় পাতায় লেপ্টে আছে কালি। বাঁধাইয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের আঠা। এর ফলে বইয়ের স্থায়িত্ব নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, নবম শ্রেণীর উল্লিখিত ১২টি বিষয়ে দুই কোটি বই ছাপা হবে। যথাসময়ে এগুলোর ছাপা শেষ করা কোনো ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাপার কাজ শুরুর ব্যাপারে চুক্তি করেনি। তবে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বাকিরা বই ছাপছে। হয়তো বিজ্ঞান, মানবিক বা বিজনেস স্টাডিজের বই একটু বিলম্ব হবে। কিন্তু ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে মূল বইগুলো চলে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজ বা কালিতে ছেপেছে বলে অভিযোগ এসেছে। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া তো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এ ব্যাপারে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

মাধ্যমিকের উল্লিখিত ১২ পাঠ্যবই এবার সহজভাবে লেখায় এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ‘সুখপাঠ্য’। এ কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখেন কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বইয়ের ছাপামান দেখতে শনিবার রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় তিনি পরিদর্শনে যান। সেখানকার একটি ছাপাখানায় নবম শ্রেণীর জীববিজ্ঞানের বইয়ের ছাপামান দেখে তিনি আপত্তি জানান। তাৎক্ষণিকভাবে ওই বইয়ের সংশ্লিষ্ট ফর্মার ছাপার কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয় এনসিটিবি। অন্য ছাপাখানায় গিয়ে তিনি দেখেন সেখানে ছাপাই শুরু হয়নি। এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

শুধু নবম শ্রেণীর জীববিজ্ঞানই নয়, অন্যসব শ্রেণীর বইয়ের ছাপার মানও নিম্নমানের। এনসিটিবি এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের কাজ তদারকির জন্য দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ পাওয়া ছাপাখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন। কমিটির প্রতিবেদনেও একই তথ্য উঠে এসেছে।

এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কয়েক দিন আগে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের কাগজে ছাপানো বই ধরা পড়ে। তাৎক্ষণিক প্রমাণিত হয়, ৫৫ জিএসএমের (পুরুত্ব) কাগজে বই ছাপানো হয়েছে। অথচ ওই বই ৬০ জিএসএমে ছাপানোর কথা। তখন সেখানেই ২৫ হাজারের বেশি বই বাতিল করা হয়। এ ছাড়া এনসিটিবির নিজস্ব টিমের অভিযানে পিএ প্রিন্টার্সের কাগজের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠান নয়, বিভিন্ন স্তরের কাজ নেয়া অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের কাগজ, ছাপা, বাঁধাই ইত্যাদির মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।

৭ নভেম্বর প্রাথমিক স্তরের বইয়ের উপর একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা পড়ে মন্ত্রণালয়ে। তাতে দেখা যায়, এ স্তরের বই ছাপায় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করায় বলাকা প্রিন্টার্সের ১১০ টন, লেটার অ্যান্ড কালারের ১৪০ টন, লিখন আর্ট প্রেসের ৫০ টন, এস আর প্রিন্টার্সের ৬০ টন, প্রিয়াংকা ৫০ টন, জুপিটার ও সীমান্ত নামে দুটি প্রিন্টার্সের ১০০ টন, সাগরিকা ১৯০ টন, পিএ প্রিন্টার্স ২০ টনসহ আরও কয়েকটি ছাপাখানার নিম্নমানের কাগজ বাতিল করা হয়। এ ছাড়া ছোট ছোট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজের ছাড়পত্র না দিয়ে বাতিল করা হয়। এভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার টন কাগজ বাতিল করা হয় বলে জানা গেছে।

এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এবার প্রাথমিকের বইয়ের কাগজের জিএসএম ৮০ এবং মাধ্যমিকের বইয়ের কাগজের জিএসএম ৬০ করা হয়েছে। পুরুত্ব আলাদা হলেও উভয়ের কাগজের উজ্জ্বলতা ৮৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। কালির মান নিশ্চিত করে সেই কাগজে বই ছাপানো হলে ঝকঝক করার কথা। কিন্তু ছাপানো বই দেখে মনে হয় যেন নিউজপ্রিন্টে ছাপানো হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে অসাধু ছাপাখানা মালিকরা এই অপকর্ম করছে। ফলে বই শিক্ষার্থীদের কাছে তেমন আকর্ষণীয় মনে হয় না। এমনকি এবারও ভালোমানের বেশি দামের সরকারি কাগজ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বেচে দিয়ে কম দামের কাগজে বই ছাপছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদস্য ড. রতন সিদ্দিকী বলেন, আমাদের কাছে যে মেশিন আছে তা দিয়ে কাগজের কেবল পুরুত্ব নির্ণয় করা যায়, উজ্জ্বলতা পরিমাপ করা যায় না। তিনি বলেন, পরবর্তীকালে উজ্জ্বলতা পরিমাপ শেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ছাপার অগ্রগতিও ভালো নয় : অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু মানই নয়, বইয়ের ছাপার অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে মাধ্যমিকের একাংশ এবং ইবতেদায়ি ও দাখিল স্তরের সব বই ছাপা শেষে সরবরাহও শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত পিএ প্রিন্টার্স, হাওলাদার, আবুল, আনোয়ার, নিউ ফাইভ স্টার, মনির, নাজমুন নাহারসহ অন্তত ১৯টি প্রতিষ্ঠান একটি বইও সরবরাহ করেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় দুই কোটি বই আটকা পড়েছে।

এনসিটিবির এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিএ প্রিন্টার্স প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা স্তর মিলিয়ে সাতটি লটের কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে ২২০ প্যাকেজের টেন্ডারে ১৩ ও ১২৪ নম্বর লটের কাজ পায় তারা। ওই দুই লটের একটি বইও এ পর্যন্ত সরবরাহ করেনি। অপর দিকে অন্য টেন্ডার থেকে পাওয়া যেসব বই প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করেছে, তার কাগজের মান নিম্নস্তরের। এই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল এনসিটিবির কোনো ছাড়পত্র না নিয়েই তিন লাখ বই সরবরাহ করেছে। ওইসব বই ছাপার আগে কাগজ টেস্ট করাও হয়নি। এসব বইয়ের মান নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

অবশ্য এনসিটিবি চেয়ারম্যানের দাবি, পাঠ্যবইয়ের মুদ্রণ অগ্রগতি ভালো। এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ সরবরাহ সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, আগামী বছরের জন্য সরকার প্রায় ৩৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপাচ্ছে।

Back to top button