জাতীয়

ফের আগুনে পুড়ল রাজধানীর সাততলা বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ছয় মাসের ব্যবধানে ফের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে।

সোমবার রাত সোয়া ৪টার দিকে আগুন লাগার পর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই করে নিভে আগুন।
বনানী থানার ওসি নূরে আজম বলেন, এই বস্তিতে হাজারখানেকের বেশি ঘর আছে। “আগুন লাগার পর প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট কাজ শুরু করে। পরে আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আরও বাড়ানো হয় ইউনিটের সংখ্যা।”

সবশেষ গতবছর ২৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ভয়াবহ আগুনে এই বস্তির প্রায় আড়াই শতাধিক ঘর পুড়ে গিয়েছিল।

২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও আগুনে পুড়েছিল সাততলা বস্তি। মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে ৫০ একর জমি বেহাত হয়েছিল, তার বড় অংশ জুড়ে এই সাততলা বস্তি।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ৮ একর জমি দখল করে সাততলা বস্তি গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের দুই পাশ ঘিরে বস্তির অবস্থান।

ধ্বংসস্তূপে নিজের ঘরটাও চিনতে পারছেন না অনেকে:

আগুনে পুড়ে গেছে মহাখালীর সাততলা বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক রফিকুল ইসলামের ভাড়া করা ঘর। যে ঘরে ছিল একখানা খাট, ফ্রিজসহ সংসারের আরও অনেক কিছু। আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে পড়েন রফিকুল। একমুহূর্ত দেরি না করে দুই ছেলে সুমন আর সজীব এবং স্ত্রীকে নিয়ে দৌড়ে চলে যান রাস্তায়। ঘণ্টা তিনেক পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ঘরের সামনে আসেন রফিকুল। ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই।

দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকায় সাজানো ঘর হারিয়ে রফিকুল এখন নির্বাক। কোথায় থাকবেন, সন্তানদের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দেবেন, এমন সব চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরেছে। ঘরে নগদ পাঁচ হাজার টাকা ছিল। তা-ও পুড়ে ছাই। হাতে একটি পয়সা না থাকায় কিছুই ভাবতে পারছেন না রংপুরের রফিকুল।

রফিকুল বলেন, ‘আমার ঘরের একটা জিনিসও নিতে পারিনি। গায়ে একটা গেঞ্জি ছিল। সে অবস্থায় বেরিয়ে গেছি। আমি রিসকা চালাই। রিসকা চালিয়ে যা জিনিস কিনছিলাম, সব পোড়া শেষ।’

কেবল রফিকুল নয়, তাঁর মতো সাততলা বস্তির আরও বহু মানুষ তিন ঘণ্টার ব্যবধানে পথে বসে গেছেন। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন লাগে গতকাল সোমবার ভোররাত ৪টায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে সাতটার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে কেউ মারা না গেলেও পুড়েছে কয়েক শ ঘর। ভোররাতে আগুন থেকে বাঁচতে যে যেভাবে পেরেছেন ঘর ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আবার যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন ছুটে আসেন নিজের ঘরটি কী অবস্থায় আছে তা দেখতে। আগুনে এতটাই পুড়েছে যে অনেকে তাঁর নিজের ঘরও চিনতে পারছিলেন না। সেখানে ছিল শুধু আহাজারি।

সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শহিদুল ইসলাম নিজের ঘরে এসে দেখেন, সব পুড়ে গেছে। ঘরে ছিল স্ত্রীর কানের দুল, হাতের বালা। পোড়া ঘরের জিনিসপত্রের ভেতর সেগুলো খুঁজছিলেন। হঠাৎ করে তাঁর চোখ যায় পোষা পাখির খাঁচার দিকে। আগুন লাগলে নিজেরা বের হয়ে গেলেও পাখির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। শহিদুল দেখতে পান, পাখি দুটি আগুনে পুড়ে গেছে।

বস্তির নিম্ন আয়ের এসব মানুষের বেশির ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত। কেউ রিকশা চালান, কেউবা হকারি করেন।

সংসারের সব জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ায় সাততলা বস্তির শত শত মানুষ মুহূর্তের মধ্যে পথে বসে গেছেন। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এসব মানুষ সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।
আগুনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লিটন মিয়া বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের দিকে একটু তাকাই, তাহলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াইতে পারমু। আমরা সরকারের একটু সহযোগিতা চাই।’

দুই নাতি বাঁচলেও সব পুড়ে ছাই:

‘ধার কইরা ৪০ হাজার টাকার মাল (কাপড়) কিনছিলাম। সব পুইড়া গেছে। ঘরে ২০ হাজার টাকা, কাপড়, ঘরের মালপত্র সব আগুনে পুইড়া গেছে। নাতি দুইডারে বাঁচাইতে গিয়ে কিছুই লইতে পারি নাই। আমার আর কিছুই নাই। এহন আমি কী করমু, কীভাবে দিন যাইবো?’

কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন এক বস্তিবাসী। রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুনে তার সব সম্বল পুড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে গোছানো অর্থ ও প্রয়োজনীয় মালামাল ছাই করে দিয়েছে আগুন। ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে এখনো ধোঁয়া উড়ছে। তার মধ্যে নিজের শেষ সম্বল খুঁজছেন তিনি।

বরিশাল থেকে এসে পাঁচ বছর ধরে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ছেলে, ছেলের বউ ও দুই নাতিকে নিয়ে থাকতেন তিনি। গত রাতের আগুনে বস্তির শতাধিক ঘরের সঙ্গে তাদের ঘরটিও পুড়ে গেছে।

তিনি জানান, বস্তিতে ছেলে, ছেলের বউ ও দুই নাতিকে নিয়ে থাকতেন তিনি। বড় নাতির বয়স ৬ বছর, ছোটটার ৯ মাস। পরিবারের সবাই মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাড়ি-লুঙ্গি বিক্রি করতেন। এতে ভালোই চলছিল তাদের। ব্যবসা বাড়াতে গত কয়েক মাস আগে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শাড়ি-লুঙ্গি কিনে ঘরে রেখেছিলেন। কাপড় বিক্রির প্রায় ২০ হাজার টাকা ও কিছু কাপড় ঘরে ছিল। রাতের আগুনে সব পুড়ে গেছে। সেই সঙ্গে ছাই হয়ে গেছে তার সুখের সংসার।

Back to top button