আইন-আদালত

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল

১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধানপরিপন্থী : প্রধান বিচারপতি * ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানপরিপন্থী হয়নি : অ্যাটর্নি জেনারেল * আদালত সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করতে পারেন না -সুপ্রিমকোর্ট * সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হল – ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ থেকে নিয়ে সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের দুই সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের সুযোগ তৈরি হল। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়।

Image result for সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল

৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগ মনে করেন, আদালত ও পার্লামেন্টের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সংহতি থাকা উচিত। আদালত বা বিচারকরা সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করতে পারেন না। বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধানের পরিপন্থী বলে এ রায়ে মতামত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তবে এর সঙ্গে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি এক মত না হওয়া এবং অর্ডার অব দ্য কোর্টে ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না করায় ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়েছে বলে মনে করেন না অ্যাটর্নি জেনারেল।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণে সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন সুপ্রিমকোর্ট। ৩ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এ রায় দেন। এতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এই রায়ের মাধ্যমে সংসদ বিচারপতি অভিশংসনের ক্ষমতা হারায়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতির স্বাক্ষরের পর মঙ্গলবার সকালে এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এদিন দুপুরের দিকে ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের কপি সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়।

এ রায় সম্পর্কে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, পুরো রায় না পড়ে কিছুই বলবেন না। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলেছেন, এটা সংবিধানপরিপন্থী। কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন সেখানে এটা পেলাম না। তিনি বলেন, রায়ের ভেতরে যাই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে কি বলা আছে, সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট যেটি, সেখানে কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। আমি বলব, এটি একজন বিচারপতির অভিমত হতে পারে। কিন্তু রায়ের শেষাংশে, যেটিকে আমরা অর্ডার অব দ্য কোর্ট বলি, সেখানে ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলা হয়নি। তাহলে ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়েছে বলে ধরা যায় না।’ মাহবুবে আলম বলেন, ‘১১৬ অনুচ্ছেদকে যদি বাতিল করতে হতো, তাহলে সবাইকে সেখানে স্বাক্ষর করতে হতো। অর্ডার অব দ্য কোর্ট তাই হতো।’ এ রায়ের রিভিউ করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ফলে ৯৬(৩) অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হল। ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধ-অবৈধ নিয়ে এ মামলায় বিচার্য বিষয় ছিল না অতএব এটা বৈধ-অবৈধের প্রশ্ন অবান্তর বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিমকোর্টের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই রায় বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে সময় নিচ্ছে সরকার। এ রায়ের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ অবৈধ ঘোষণার মামলায় বিষয়টি সুরাহা করল। আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় বিচারক অপসারণে এখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ৯৬(৩) অনুচ্ছেদের বিধান কার্যকর হবে। এ ধারায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে।

রায়ে বলা আছে, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদের কাউকে পদচ্যুত করতে গেলে সেটা অবশ্যই তার চেয়ে উচ্চপদস্থদের আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লর্ড ডেনিংয়ের কথা উল্লেখ করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা আছে, ‘যদি কাউকে বিশ্বাসই করতে হয় তবে বিচারকদের করো।’ (সামওয়ান মাস্ট বি ট্রাস্টেড, লেট ইট বি দ্য জাজেস)। সংবিধানের ৫ম ও ৮ম সংশোধনী অনুসারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের অনুমোদন দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। এই কাউন্সিল এখন সংবিধানেরও অংশ হয়ে গেছে, কারণ সর্বোচ্চ আদালতের রায় সাংবিধানিকভাবেই চূড়ান্ত।’

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে বিচারপতিদের অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাতিল করেন। এ সময় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।

প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের দুই সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের বিধি অনুযায়ী কমিটির শীর্ষস্থানীয় সদস্যদের স্বচ্ছ বলে বিবেচনা করে সুপ্রিমকোর্ট।

রায়ে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি ‘সুপ্রিমকোর্ট’-এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতির’ ওপর ন্যস্ত করার বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে শব্দের এই প্রতিস্থাপন সংবিধানপরিপন্থী বলেও অভিমত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ মতামতের সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। তবে প্রধান বিচারপতির এ মতের সঙ্গে একমত হতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আর বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও মোহাম্মদ ইমান আলী বলেছেন, এখানে অন্য ইস্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে তার সঙ্গেও বিচারপতিরা একমত পোষণ করেছেন রায়ে। সংসদ সদস্যদের নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্চ (বাদ দিয়ে) করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের যেসব শব্দ নিয়ে আদালতের বন্ধু আইনজীবীরা আপত্তি তুলেছিলেন সেগুলো এক্সপাঞ্চ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট থেকে দেয়া পর্যবেক্ষণের অংশ তুলে ধরে তা কেন এক্সপাঞ্চ করা হয়েছে, তা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে পরস্পরের মধ্যে কী ধরনের অবস্থান থাকা উচিত, সেটি বিবরণীতে রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আদালত বা বিচারকরা সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করতে পারেন না। আদালত ও পার্লামেন্টের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সংহতি থাকা উচিত। পাশাপাশি সংসদেরও সুপ্রিমকোর্টের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়, যা পার্লামেন্টের কার্যক্রম সম্পর্কিত সাংবিধানিক ধারা ৭৮(২) এবং ২৭০ এবং ২৭১ নম্বর রুলসে নিষিদ্ধ।

৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সংসদ সদস্যদের নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্চ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের আপিল বিভাগ। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। রায় ঘোষণার প্রায় এক মাস পর মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করলেন আপিল বিভাগ। রায়ে আদালত বলেন, ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হল- আপিল খারিজ। তবে হাইকোর্টের রায়ে উল্লিখিত কিছু পর্যবেক্ষণ বাদ দেয়া হবে।’

এটা পাকিস্তানের কনসেপ্ট -অ্যাটর্নি জেনারেল : রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কনসেপ্টটা (ধারণা) হল সেনা শাসকদের কনসেপ্ট, পাকিস্তানের কনসেপ্ট, মেজর জিয়াউর রহমানের কনসেপ্ট। কাজেই এটা পুনঃস্থাপনে আমি ব্যথিত। নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এ রায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সবাই ঐকমত্য হয়েছেন। আলাদা কেউ রায় দেননি। রায়ের শেষ অংশে যেটা বলা হয়েছে সেটা হল, সর্বসম্মতিক্রমে আপিলটাকে ডিসমিস করেছেন। সংবিধানের ৯৬-এর (২) থেকে (৭) অনুচ্ছেদ পর্যন্ত পুনঃস্থাপন করেছেন। এবং রায়ে বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে তার সঙ্গেও তারা একমত করেছেন। অর্থাৎ যদিও প্রধান বিচারপতি রায়ের এক জায়গায় সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা সংবিধান পরিপন্থী।’ কিন্তু রায়ের শেষাংশে যেখানে সবাই একমত হয়েছেন, সেখানে এটা পেলাম না।

মাহবুবে আলম বলেন, ‘টোটাল বিষয়টি দাঁড়াল, মার্শাল আমলে সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেটিকে আবার পুনঃস্থাপন করা হল।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রায়ের ভেতরে যাই বলা থাকুক না কেন, রায়ের সমাপনীতে কী বলা আছে, সেটি দেখতে হবে। অর্ডার অব দ্য কোর্ট কোনটা, সেখানে কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখন উনারা রিস্টর করেছেন। কিন্তু আমার বক্তব্য হল, সংবিধানের যে কোনো ধারা সংশোধন করা, বাদ দেয়া- সবটাই সংসদের ব্যাপার। কোর্ট যদি নিজেই রিস্টর (পুনঃস্থাপন) করে দেন তাহলে সংসদের থাকার কোনো দরকার হয় না, তাই না! আমার কথা হল, সংবিধানের যে কোনো সংশোধনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু সংবিধানের কোনো ধারা পুনঃস্থাপন বা রিস্টর করা আমার বিবেচনায় সংসদের কাজ। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর করতে এখন আইন করতে হবে কিনা বা আইন না করলে এটা কার্যকর হবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এ মুর্হূতে বলা কঠিন। এ নিয়ে এ মুর্হূতে কোনো কমেন্টস (মন্তব্য) আমি করব না।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ : সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, এ রায়ের মাধ্যমে আদালত ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এখন সংবিধানে ৯৬(৩) অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হবে। সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে নিন্ম আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি ‘সুপ্রিমকোর্ট’-এর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতির’ ওপর ন্যস্ত করার বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী বলে অভিমত দিয়েছেন আদালত।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাসদার হোসেন মামলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হয়তো আদালত এ অভিমত দিয়েছেন। কোনো সংশোধনী যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তা বাতিল করার এখতিয়ার সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে আছে। এখন প্রশ্ন হল, ১১৬ অনুচ্ছেদ আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল কিনা। প্রাসঙ্গিকভাবে এ বিষয়টি আসছে কিনা, তা রায় না দেখে বলা যাবে না।

ড. শাহাদীন মালিক : এ প্রসেঙ্গ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহাদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, একটা রায়ে অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় আসে। তাছাড়া ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধ-অবৈধ নিয়ে এখানে কোনো বিষয় ছিল না। অতএব এটা বৈধ-অবৈধের প্রশ্ন অবান্তর।

মামলার প্রেক্ষাপট : বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বিল অনুসারে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’ ৩ দফায় বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাবসম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবে।’ একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের ৯ জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ৪ জানুয়ারি আপিল করে। আপিলের ওপর ৮ মে শুনানি শুরু হয়, যা ১১তম দিন ১ জুন শেষ হয়। ওই দিন আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। ৩ জুলাই রায়ের সংক্ষিপ্তসার ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

বিচারক অপসারণ প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলায় আপিল বিভাগে ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়। আপিল বিভাগ মনোনীত ১২ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে ১০ জন আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে ৯ জনই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তারা হলেন- বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, তিন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ, এজে মোহাম্মদ আলী ও ফিদা এম কামাল, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এমআই ফারুকী। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে অর্থাৎ সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের পদ্ধতি যথাযথ বলে যুক্তি তুলে ধরেন। দুই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কোনো মতামত দেননি। ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার আপিল শুনানিতে সহায়তার জন্য আপিল বিভাগ ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

Back to top button