প্রবাস

সৌদির নতুন আইনে কাজ হারাবে কয়েক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক

সৌদি আরবের ফ্যাশন রিটেইল কোমপানি আল হকার এ দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত কাজ করেছে মো. জহিরুল ইসলাম ও গোলাম সরওয়ার। সৌদি সরকারের নতুন আইন অনুযায়ী তাদের জায়গায় সৌদি নাগরিক নিয়োগ দেওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে এ দুইজন।

ওই কোম্পানির অন্য কোথাও কাজের জায়গা খালি না থাকায়, তাদের ট্রান্সফার নিয়ে অন্য কোথাও কাজ করতে কিংবা দেশে ফিরে যেতে নোটিস দেয়া হয়েছে।

তাদের মতো ১০ লাখ বাংলাদেশীসহ ১ কোটি ৭৯ লাখ কর্মী কাজ করছেন সৌদি আরবের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যাদের প্রায় সবার ভাগ্যেই ঘটতে যাচ্ছে একই পরিণতি। সৌদি ভিশন-২০৩০ অনুযায়ী, খুচরা দোকানগুলোতে ১৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র ৩ লাখ সৌদি নাগরিক।

সৌদি আরবে শ্রমিকদের চাকরি হারানো সংক্রান্ত এ বছরে প্রথম ধাক্কাটি আসে গত বছর ২১শে এপ্রিল।

সৌদি প্রশাসন একটি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে জানায়, এখন সৌদি আরবের শপিংমলগুলোতে প্রবাসীরা চাকরি করতে পারবে না। দেশটির নাগরিকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। এই সিদ্ধান্ত কাযকর করায় সৌদিতে শপিংমলে কর্মরত কয়েক হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মীর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তারা পুনরায় চুক্তি করবে না এমনটাই জানায় দেশটির শ্রম দপ্তরের মুখপাত্র খালেদ আবাল খাইল।

ভঙ্গুর অর্থনীতি- বার্ষিক বাজেট ঘাটতি, ইয়েমেনের সাথে পড়শি সংঘাতসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত সৌদি আরব। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করে। যাতে সৌদি নাগরিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির করতে প্রবাসীদের ওপর ১২ ধরনের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। যাদের মধ্যে রয়েছেন নির্মাণ ও পোশাক খাতের শ্রমিকরা।

বছরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হওয়া সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই আইনে ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন ও সৌদি নাগরিকদের কর্মসংস্থান বাড়াতে দেশটিতে মোবাইল, বোরকার দোকান, রেন্টে কার, হিসাব রক্ষণ, নারীদের তৈরি পোশাকের দোকানের পর এবার নতুন করে ১২ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রবাসীদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সৌদির শ্রম মন্ত্রণালয়।

জেদ্দা কনস্যুলেট জেনারেল এফ এম বোরহান উদ্দিন বলেছে, “নতুন আইন অনুযায়ী- চশমা, ঘড়ি, বাড়ি বা গৃহ নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ির যন্ত্রাংশ, গাড়ির শো রুম, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎচালিত সামগ্রী, হাসপাতালে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, চকলেট বা মিষ্টান্নের দোকান, রেডিমেড কাপড়ের দোকান, ক্রোকারিজ সামগ্রী, কার্পেট, ফার্নিচার বা ডেকোরেশনের দোকানে কাজ করতে না পারলে অনেক বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিক বেকার হতে যাবে । এ ক্ষেত্রে অন্যত্র তাদের কাজের সুযোগ এ মুহুর্তে নেই।”

সৌদি জাতীয়করণ বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে বলে জানিয়েছে দেশটির অর্থনীতি ও পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মদ আলী-তুওয়াইজিরি। সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক আল-আরাবিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মত জানায়।

সৌদি আরবের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয়ের অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক কাজ হচ্ছে বিদেশি শ্রমিকের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনা।

সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ এর প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশটির নারী ও পুরুষরাই সক্ষম বলেও তিনি মন্তব্য করেছে।

দেশটির সাধারণ পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, গত বছরের তৃতীয়ার্ধে সৌদি আরবের সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ৬৯ লাখে পৌঁছায়। একই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এই শ্রমিকের সংখ্যা কমে এক কোটি ৭৯ লাখ হয়। অর্থাৎ গত বছরই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ কমেছে দেশটিতে।

সৌদি আরবে বর্তমানে বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। বেকারত্ব কমিয়ে আনতে ইতোমধ্যে দেশটির ইন্স্যুরেন্স, যোগাযোগ ও পরিবহনসহ প্রধান প্রধান কিছু খাতে নাগরিকদের প্রাধান্য দিচ্ছে সৌদি সরকার।

বেকারত্বের হার প্রসঙ্গে সৌদি মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী-তুওয়াইজিরি বলে, “আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই বেকারত্বের হার সাত শতাংশে কমিয়ে আনতে চায় সৌদি; যাতে পড়াশোনা শেষ করা সৌদি নাগরিকরা প্রত্যেক বছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে।”

চলতি বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে অনুমান করেছে সৌদি আর্থিক কর্তৃপক্ষ (এসএমএ)। তবে সৌদি এই মন্ত্রী বলেছে, আড়াই শতাংশ থেকে ৩ শতাংশের মাঝে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই আমাদের লক্ষ্য।

ভিশন ২০৩০ অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে ৯ শতাংশ হারে বেকারত্ব হার কমানো জোর পরিকল্পনা নিয়েছে সৌদি সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে এর হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। দেশটির সরকার আরো ঘোষণা দিয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে ১২ লাখ কর্মসংস্থান জাতীয়করণ করবে।

তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসা, প্রযুক্তিখাতে তরুণ নাগরিকদের কর্মসংস্থানে নতুন নতুন খাত তৈরি, নারীর ক্ষমতায়ন ও নাগরিকদের জীবনযাপনের ওপর কড়াকড়ি শিথিলের করছে।

তবে সৌদি সরকারের এ নীতিতে বাংলাদেশের মত দেশগুলোর প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

Back to top button