জাতীয়

 আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে বাগেরহাটের সেই সাবেক পিয়নের বিরুদ্ধে!

নিজস্ব প্রতিবেদক:আবদুল মান্নান তালুকদারবাগেরহাট ডিসি (জেলা প্রশাসক) অফিসের সাবেক পিয়ন (এমএলএসএস) আবদুল মান্নান তালুকদারের মালিকানাধীন নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিতে সাধারণ গ্রাহকের জমা রাখা অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বাগেরহাট জেলা সমবায় কর্তৃপক্ষ। জেলা সমবায় কার্যালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে ঠিক কী পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থ আত্মসাৎ ছাড়াও এক ডজন অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। আবদুল মান্নান তালুকদারকে অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয়কে ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়েছে।খুলনা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের যুগ্ম-নিবন্ধক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী আবদুল মান্নান তালুকদারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। তাকে বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি তাকে উপস্থিত হতে বলা হয়েছিল। আগামী ৪ দিনের মধ্যে (৩১ জানুয়ারি) ব্যাখ্যা না দিলে আবদুল মান্নান তালুকদারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয় থেকে  প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও সম্পাদককে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তারা তা বাস্তবায়ন করেনি। সমিতির সব গ্রাহকের জন্য আমানত সুরক্ষা তহবিল গঠন করার যে নির্দেশনা ছিল, তাও তারা মানেনি।’

এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান তালুকদার ও সম্পাদক মো. জাকারিয়া আল হাসানকে চিঠি দেয় বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয়। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আর্থিক অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে সমিতির সদস্য ও পাওনাদারদের স্বার্থ চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।

বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আপনার (আবদুল মান্নান) বিরুদ্ধে সমবায় সমিতি বিধিমালা মোতাবেক কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার ব্যাখ্যা আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে দাখিল করতে বলা হলো।’এ বিষয়ে আবদুল মান্নানের বক্তব্য নেওয়ার জন্য ফোন দেওয়া হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ছেলে নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির সম্পাদক মো. জাকারিয়া আল হাসানকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।

বাগেরহাট জেলা সমবায় কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমবায় সমিতি আইন অমান্য করে সমিতির সদস্যদের জমাকৃত শেয়ারের ৪০ গুণের বেশি ঋণ দিয়েছে। অনেকক্ষেত্রে শেয়ার না থাকা সত্বেও বিপুল অংকের ঋণ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জামানত হিসাবে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল স্টেট-এ জমাকৃত মেয়াদি বিনিয়োগ থাকা সাপেক্ষে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনও অনুমোদন নেওয়া হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও কর্মচারীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ দেখিয়ে সমিতির তহবিল অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত সম্পাদিত অডিট প্রতিবেদনের সঙ্গে সমিতির সরবরাহ করা হিসাব বিবরণী ও বিস্তারিত খাতওয়ারি তালিকায় সমিতির সভাপতি সম্পাদক বা কোনও সদস্যের স্বাক্ষর নেই। ক্যাশ বই সংশ্লিষ্ট অন্য বইতেও ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনও স্বাক্ষর নেই। সমিতির সাধারণ সভার কোনও আলাদা রেজ্যুলেশন বই নেই। সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের জন্য কোনও নোটিশ সদস্যদের পাঠানো হয়নি। সাধারণ সভার রেজ্যুলেশন কপি জেলা সমবায় অফিসে পাঠানো হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আমানত সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগ না করে অননুমোদিত কর্মচারীদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম সমবায় আইন ও বিধিমালা পরিপন্থী।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১২ সালে জেলা সমবায় সমিতি, বাগেরহাট থেকে নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নিবন্ধিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা একহাজার ৩১৩ জন। এ বিষয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সমিতি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের কাছে থেকে ৩ বছর মেয়াদে ৩৫টি দোকানঘর লিজ নেওয়ার জন্য গেল বছরের ২৩ অক্টোবর চুক্তিবদ্ধ হয়; যা কার্যকর হয়েছে ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে। চুক্তি সম্পাদনের একবছর ৪ মাস আগে থেকে চুক্তি কার্যকর বেআইনি বলে মনে করে পরিদর্শক দল। এ ছাড়া, জেলা সমবায় অফিস, বাগেরহাট কর্তৃক সম্পাদিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দোকানঘর লিজ গ্রহণ বাবদ ৮১ লাখ ২৯ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। জেলা সমবায় অফিসের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং চুক্তিপত্রে উল্লেখিত মূল্যমানের মধ্যে পার্থক্য থাকায় বিষয়টি বিভাগীয় অফিস কর্তৃক পুনরায় তদন্ত করা আবশ্যক মর্মে অভিমত দিয়েছে পরিদর্শক দল।

এদিকে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আবদুল মান্নান তালুকদারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে আবদুল মান্নানের পিয়ন থেকে কোটিপতি হওয়ার তথ্য উঠে আসে।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে একজন গ্রাহক অভিযোগ করেন, আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট নামের কোম্পানিটি উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে চার হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে। আর নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি একই পন্থায় আড়াই কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে। ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে-টু ও হুন্ডিকাজলের মতো মান্নানের গড়া প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, নড়াইল ও সাতক্ষীরার প্রায় ৪০ হাজার লোক সর্বস্ব হারাতে বসেছে মর্মে তিনি পত্রে উল্লেখ করেন।

তবে আবদুল মান্নান তালুকদার কাছে দাবি করেছেন, আয়করের বাইরে তার কোনও সম্পদ নেই। তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে সম্পদ বানানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি ব্যবসার মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছি।’

Back to top button