অর্থ-বাণিজ্য

চাকরির বাজার ভারতীয়দের হাতে

বৈধ-অবৈধ ভারতীয় নাগরিকদের দখলে চলে যাচ্ছে দেশের চাকরির বাজার। দেশীয় বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি ভারতীয়দের একচেটিয়া নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ওয়ার্কপারমিট নিয়ে গার্মেন্ট, বায়িং হাউস, এয়ারলাইন্স ও বিভিন্ন বিপণন প্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক ভারতীয় কাজ করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় এদের আয়ের সঠিক হিসাব নেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে। ফলে মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা পেলেও রাজস্ব দিতে হয় না এসব অবৈধ বিদেশির। আবার বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ পদের প্রায় সবই ভারতীয় নাগরিকের দখলে থাকায় বাংলাদেশী নাগরিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি বেতন-ভাতা পাচ্ছে তারা। নিয়ে দেশ থেকে পাচার করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। বাংলাদেশে একাধিক বহুজাতিক কোম্পানির অফিসে খোঁজখবর নিয়ে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে কাজ করছে। এদের বেশিরভাগই ভারতীয় নাগরিক। ভারতীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ছাড়া এসব ভারতীয় কাজ করছে বিভিন্ন বায়িং হাউস, পোশাক কারখানা, ফ্যাশন হাউস, এয়ারলাইন্স কোম্পানিতে। এসব কোম্পানির শীর্ষ পদের সবই ভারতীয়দের দখলে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রম আইন যেমন মানা হচ্ছে না, তেমনি বৈধ ওয়ার্ক পারমিটও নেই অধিকাংশ ভারতীয়র।
এয়ার ইন্ডিয়ার ঢাকা অফিসে স্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে ৯ কর্মকর্তা। এর মধ্যে শীর্ষ তিনটি পদের সবক’টির ভারতীয়দের দখলে। অপর ৬ কর্মকর্তার মোট যা বেতন-ভাতা, তার দ্বিগুণ ভোগ করে ভারতীয় একেকজন কর্মকর্তা। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলছে না কেউই। যে তিন ভারতীয় নাগরিক শীর্ষ তিনটি পদে আছে, তারা আইন অমান্য করে আছে। বিনিয়োগ বোর্ড বাংলাদেশে কোনো বিদেশি কোম্পানিতে বিদেশি নাগরিক নিয়োগের শর্ত হিসেবে ১:৫ অনুপাতে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ৩ ভারতীয় নাগরিকের বিপরীতে শীর্ষ ৯টি পদের জন্য ১৫ জন বাংলাদেশী নিয়োগ পাওয়ার কথা। তবে এয়ার ইন্ডিয়ার ঢাকা অফিসে সর্বমোট ১৩ জন স্টাফ কাজ করছে। এর মধ্যে ৪ জন আবার অস্থায়ী ভিত্তিতে আছে।
একই অবস্থা বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। প্রতিষ্ঠানটি চেয়ারম্যান ও এমডিসহ বেশিরভাগ শীর্ষ পদই দখল করে আছে ভারতীয়রা। বাংলাদেশী কর্মীরা নীতিনির্ধারণী পদে তেমন পাত্তা পাচ্ছে না। যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশীরা এগিয়ে থাকলেও অজানা কারণে বারবার শীর্ষ পদগুলোয় ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়ায় কর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। ক্ষোভে, দুঃখে, হতাশায় ইউনিলিভারের চাকরি ছেড়েছেন অনেকেই।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও এমডি রাকেশ মোহন ভারতীয় নাগরিক। কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান সঞ্জিব মেহতাও একজন ভারতীয়। কোম্পানির ফিন্যান্স ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে ভারতীয় নাগরিক বিবেক আনন্দ। ভারতীয় নাগরিক জেরি জুস দায়িত্ব পালন করছে মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে। এভাবে ইউনিলিভার বাংলাদেশে দেশিদের ক্যারিয়ার ব্লক করে রেখেছে ভারতীয়রা। আর বেতনের নামে দেশে নিয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা।
জানা যায়, ইউনিলিভার বাংলাদেশে পরিচালনা পর্ষদে মোট ছয়টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে পর্ষদের তিনটি পদ ভারতীয় নাগরিকের দখলে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটিতে শতকরা ৯৯ দশমিক ৫০ ভাগ কর্মী বাংলাদেশ থেকে নিয়োগ দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর শতকরা আধাভাগ কর্মী বিদেশ থেকে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। এ নিয়মের সুযোগ নিয়ে বিদেশি কোটায় ভারত থেকে একের পর এক ভারতীয়ের নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে ইউনিলিভার। তবে বিদেশি কোটায় সাধারণ কর্মী বা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ না দিয়ে তাদের দেয়া হচ্ছে প্রশাসনিক দায়িত্ব।
কোম্পানির তথ্যমতে, ইউনিলিভার বাংলাদেশে মোট ১০ হাজার কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় চার হাজার কর্মী মাঠপর্যায়ে কাজ করে থাকেন। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পরও তাদের সামান্য বেতন দেয়া হয়। বিক্রয় কর্মীদের কোম্পানির পক্ষ থেকে নিয়োগ না দিয়ে বিভিন্ন পরিবেশকের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয় বলে জানা গেছে। তাদের নিয়মিত শ্রমিকের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা না দেয়ার জন্য এমনটি করা হয় বলে জানা গেছে।
আবার কোম্পানির কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গেও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। জানা গেছে, ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমিক ইউনিলিভারে নিয়মিত। তাদের বেশ ভালো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। তবে বাকি ৮০ ভাগ শ্রমিকের সঙ্গেই ইউনিলিভার বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, অনিয়মিত শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। বছরের পর বছর কাজ করলেও তাদের নিয়মিত করে প্রাপ্য মজুরি দেয়া হয় না।
জানা যায়, মাঠপর্যায়ে ও ফ্যাক্টরিতে বাংলাদেশের শ্রমিকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সামান্য বেতন পান, আর ভারতীয় শীর্ষ কর্তারা বেতন হিসেবে নেন বিপুল পরিমাণ টাকা। তাছাড়া বিদেশে কাজ করার জন্য তারা কোম্পানি থেকে পান আনুষঙ্গিক অনেক সুবিধা। এভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ৪০ শতাংশ শেয়ার থাকা এ কোম্পানির আয়ের বিপুল পরিমাণ টাকা ভারতে চলে যাচ্ছে।
সরকারের দুর্বলতার সুযোগেই ইউনিলিভারে একের পর এক ভারতীয় নাগরিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে ইউনিলিভারের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না।
এদিকে রফতানির বড় খাত পোশাক শিল্পে প্রায় ২৬ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছে—যাদের দুই-তৃতীয়াংশই ভারতীয় নাগরিক। জানা গেছে, পোশাক শিল্পে যেসব বিদেশি কর্মকর্তা আছেন, তাদের একেকজনের মাসিক বেতন ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। পোশাকের ডিজাইন ও ফ্যাশন কাজে নিয়োজিত বিদেশি শ্রমিকরা চড়া বেতন পেলেও স্থানীয়রা পাচ্ছে অর্ধেক বেতন।
এ বিষয়ে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ আমার দেশ-কে জানিয়েছেন, তারা এ নিয়ে কাজ করছেন। তবে এয়ার ইন্ডিয়া বা ইউনিলিভারে অবৈধভাবে বা আইন না মেনে যে ভারতীয় নাগরিকরা কাজ করছেন, বিষয়টি তাদের নজরে নেই। অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত বিদেশি নাগরিকের দুই-তৃতীয়াংশই ভারতীয়, বাকিরা শ্রীলঙ্কান। এদের সবাই পোশাক কারখানার ফ্যাশন ডিজাইনার বা টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারিভাবে টেক্সটাইল ডিপ্লোমা কোর্স ছাড়া আর কোনো কোর্স চালু নেই; নেই তৈরি পোশাকের দক্ষ শ্রমিক গড়ার কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে তিনি সরকারের পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করেন। এছাড়া রয়েছে আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতা। বিজিএমইএ সভাপতি জানান, বিদেশি ডিজাইনার ও টেকনিশিয়ানদের অনেক বেশি বেতন দিয়ে কাজ করাতে হয়। দিতে হয় গাড়ি-বাড়িসহ বাড়তি অনেক সুবিধা। সব মিলে একেকজন বিদেশি ডিজাইনার ও টেকনিশিয়ানের পেছনে মাসিক খরচ পড়ে ২ থেকে ৪ হাজার মার্কিন ডলার। পোশাকশিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি কারখানাতেই এক বা একাধিক ফ্যাশন ডিজাইনার ও টেকনিশিয়ান কাজ করছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে কোনো নজর দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কিছু কাজ শুরু করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগুলো দক্ষ শ্রমিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে।
সূত্রমতে, ভারতীয় নাগরিকের বেশিরভাগই এদেশে ‘ট্যুরিস্ট ভিসায়’ এসে আর ফেরত যাচ্ছেন না। কাজের ক্ষেত্র খুঁজে নিয়ে থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশেই। এসব অবৈধ অভিবাসীর প্রকৃত পরিসংখ্যান সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই। পুলিশও তাদের খুঁজে পায় না।
জানা গেছে, এসব অভিবাসী কোনো কোনো ক্ষেত্রে একবার ওয়ার্ক পারমিট নিলেও তা আর নবায়ন করে না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জোগসাজশে এবং প্রভাবশালীদের ক্ষমতাবলেই বাংলাদেশে থেকে যাচ্ছে এসব বিদেশি। কখনও কখনও তারা এদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশি যোগ্য নাগরিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button