দেশের সংবাদ

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের কষ্ট বাড়ছে

Image result for দ্রব্যমূল্য

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার হাড়িখোলা এলাকায় ছোট্ট একটি টিনশেড রুমে থাকেন আমিনুল ইসলাম। তার মধ্যেই গাদাগাদি করে থাকে আমিরের আট সদস্যের পরিবার। রুমের মধ্যে বড় একটি চৌকি ফেলানো হয়েছে। বড় চৌকি ফেলানোর কারণ, মেঝেটার ব্যবহার যাতে বেশি করা যায়। অর্থাৎ চৌকির নিচে বিছানা করে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেখলে মনে হবে, দোতলা শোবার খাট ! এর সাথেই ৪টি টিনশেড রুম।

৪টি রুমেরই একই অবস্থা। কোনো-কোনোটিতে ১০-১১ জন করে বসবাস করছে। ৪টি রুমের বিপরীতে টয়লেট আছে মাত্র দুটি। সামান্য একটু খালি জায়গা রয়েছে যেখানে এতোগুলো মানুষের ভেজা কাপড় শুকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি কাপড়ের দোকানে কর্মরত আমির এ প্রতিবেদককে বলেন, বেতন পাই মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। ঘরের ভাড়াই তিন হাজার টাকা। কীভাবে যে চলি! তাই একটি রুমে কয়েকজন মিলে ভাড়া নেই। আমার সঙ্গে থাকে আমার পরিবার এবং দুই মামাতো ভাই। মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। তিনিও আমাকে কিছু সাহায্য করেন। আমির দুঃখ করে বলেন, বৃদ্ধ মাকে যেখানে আমার কিছু দেয়া উচিত, সেখানে মা-ই আমাকে সাহায্য করেন। বেতনের টাকা বাড়ি ভাড়াতে শেষ।

কুমিল্লার গ্রামের সহজ-সরল মানুষ ভালো নেই। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অল্পতেই তুষ্ট হওয়া এসব মানুষের মুখের হাসি হারিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় কোন ক‚লকিনারা পাচ্ছেন না অনেকে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে আবাদ করা ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়া প্রতি বছর নানা কারণে কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ।

ইরি ধান, আমন ধান, আলু,পাট ও তরি-তরকারি আবাদ করে খরচ না ওঠায় কৃষকের দুশ্চিন্তায় কেবল বাড়ছেই। অনেকে আবাদ করা ছেড়ে দিয়ে জমি পতিত রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। পাশাপাশি কুমিল্লার গ্রামে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মারামারি, হত্যা, বিভিন্ন বাহিনীর নামে চাঁদাবাজি, জবরদখল ও ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও অস্থিরতা বেড়েছে। অঞ্চলভেদে গ্রামগুলোর চিত্র ভিন্ন হলেও গ্রামে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ অস্থিরতার মধ্যে দিন পার করছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষের মনে উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় অর্ধশতাধিক গ্রামের হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ আটকা পড়েছেন সুদ বাণিজ্যের বেড়াজালে। দৈনিক ও সাপ্তাহিক কিস্তিতে কয়েকটি এনজিও সুদাসল পরিশোধের সুযোগ থাকায় অভাবী মানুষগুলো এনজিওর কাজ থেকে ঋণ গ্রহণের পর পড়ছে মহাবিপাকে। ঋণগ্রহিতারা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত হওয়ায় অনেককে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ভিটে হারা হয়ে সর্বস্বান্ত হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঋণ প্রদানের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ঋণ প্রদানের কেন্দ্র।

এসব কেন্দ্রে প্রতিদিন নিম্নবিত্ত মহিলাদের ঋণ নিতে ও কিস্তি দিতে ভিড় জমাতে দেখা যায়। এ ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল চড়াহারে সুদ আদায়ে মাধ্যমে অনেক অভাবী দরিদ্র মানুষের কাছে সুদের টাকা লাগিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। ঋণগ্রহিতা একাধিক ব্যক্তি জানান, অভাব অনটন, মেয়ের বিয়ে, চিকিৎসা এবং সংসার চালাতে তারা এনজিও এবং সমিতিতে নাম লেখায় ও ঋণগ্রহণ করে প্রতি সপ্তাহে কিস্তিতে টাকা জমা করেন। প্রতিকিস্তি তার ২০-৩০% সুদসহ টাকা জমা করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দরিদ্র্যের কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে ওই টাকা তারা সংসারের যোগান দিতে খরচ করে ফেলে। ফলে সাপ্তাহিক কিস্তি চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

সাপ্তাহিক কিস্তির দিন ঋণ পরিশোধ করতে দিশাহারা হয়ে অনেকে হাওলাত নিয়ে এবং কি গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি বিক্রি করে কিস্তির টাকা জোগান দিতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ ঘরে রক্ষিত মূল্যবান জিনিসপত্র, গাছপালাসহ স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করলেও তাতে সম্পূর্ণ ঋণ শোধ না হওয়ায় অনেক সময় শেষ সম্বলটুকু বাড়িভিটে বিক্রি করেও ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে চায় এসব ঋণগ্রস্ত মানুষগুলো।

এভাবে দিনদিন ঋণের জালে আটকা পড়েছে চান্দিনার হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বাস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষকদের অবস্থা বেশি শোচনীয় হয়ে পড়েছে। চরম অর্থ সংকটে পড়ে নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ গ্রামের মানুষের হাসিমুখ মলিন হতে চলেছে। অর্থ সংকট সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দিচ্ছে। হতাশ বেসরকারি কর্মজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করলেও বেতন বাড়েনি বেসরকারি কর্মজীবী মানুষের । অথচ দিন দিন সব পণ্যর দাম বেড়েই চলছে হু হু করে।

বাজারদরে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতির কারণে এর লাগাম টেনে ধরা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলো চরম দুরবস্থায় দিনাতিপাত করছে। নিম্ন আয়ের কয়েকজন মানুষ বলেছেন, বেতন বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। অথচ আমাদের আয় বাড়ে না। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে সংকটে মধ্যে থাকতে হয় । চান্দিনার একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে নিম্নপদে চাকরিরত আব্দুল আলিম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। সরকারের উচিত আমাদের মতো যারা ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাদেরও সমানুপাতিক হারে বেতন বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া।

তিনি আরো জানান, ব্যক্তি মালিকানাধীন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে মানুষ মাসিক মাত্র ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থাকায় আমাদের মত নিন্ম আয়ের মানুষগুলো চরম দুর্ভোগের মধ্যে থাকতে হয়। মুরাদনগর উপজেলার শ্রমিক রমজান মিয়া, শেরাফত আলী, কোরবান আলী, রসুল মিয়ার সাথে কথা বললে তারা জানান, জিনিসের দাম বাড়লেও আমাদের মজুরি সেই হারে বাড়েনি। কোনোমতে দিন এনে দিন খাই অবস্থা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতো আমাদেরও বেতন ও পারিশ্রমিক বৃদ্ধি করা দরকার।

আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি : শহরের মতো গ্রামগঞ্জেও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে অস্বস্তিতে রয়েছেন গ্রামের সব পর্যায়ের মানুষ। কুমিল্লার বিভিন্ন গ্রামে দেখা দিয়েছে গুপ্তহত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি ও জবরদখলের ঘটনা। পাল­া দিয়ে বসছে মাদকের হাট। গ্রামের তরুণরা মাদক সেবন, মারামারি, চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এলাকার দোকানে বসে অশ্ল­ীল সিডি দেখা, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, দরিদ্র পিতার পকেট থেকে টাকা চুরি করা অথবা গোলার ধান বিক্রি করে মাদকের পয়সা সংগ্রহ করাই এদের প্রধান কাজ। বেকারত্ব সহ রাজনৈতিক নেতাদের আশির্বাদে নিশ্চিত অপঘাতে অপমৃত্যুর কথা জেনেও এরা পা বাড়াচ্ছে অন্ধকার জগতে।

সূত্রঃ ইনকিলাব

Back to top button